দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে নিজ ঘরে থাকা ও দেশে চিকিৎসার জন্য নেয়ার সুযোগ করে দেয়াকে ‘যথেষ্ট উদারতা’ বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিএনপি যতই আন্দোলন করুক, বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলছে না তার।
খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করা, বাড়ির সামনে থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়ার প্রসঙ্গ সামনে এনে প্রধানমন্ত্রী উল্টো প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে আর কত আশা করে তারা? কীভাবে আশা করে?- সেটাই আমার প্রশ্ন।’
যুবলীগের ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার দুপুরে ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়নের আয়োজিত আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন সরকারপ্রধান।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে যে দাবি দলের পক্ষ থেকে তোলা হচ্ছে, সেটি আগেই নাচক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিএনপি এই দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত বিএনপি নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী কারাগার থেকে বের করে বাসায় থাকার সুযোগ দেন তার নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে। শর্ত ছিল, দেশের বাইরে যেতে পারবেন না খালেদা জিয়া।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরা আমাদের কাছ থেকে কী আশা করে? আমরা যতটুকু দিয়েছি, তাকে যে বাসায় থাকতে দিয়েছি, তাকে যে ইচ্ছেমতো হাসপাতালে নিচ্ছে, চিকিৎসা করাচ্ছে- এটাই কি যথেষ্ট না? এটাই কি অনেক বড় উদারতা আমরা দেখাইনি? সেটা তো দেখিয়েছি, আর কত? ১৯৪৪ সালে যদি তার জন্ম হয়, তাহলে তার বয়স কত? সেটাও তো দেখতে হবে।’
খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জন্য যারা দাবি জানাচ্ছে, তাদের ‘দ্বৈত মানসিকতা’ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘এ দেশের মানুষ একটা অদ্ভুত চরিত্রের। একটা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলবে আবার দুর্নীতিবাজের জন্য কান্নাকাটিও করবে, তাকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসাও করতে হবে, যারা দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত। এ দ্বৈত মানসিকতা কেন?’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি এত দিন পর একটা সুযোগ পেয়েছে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার… এই দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। খুব ভালো, তারা আন্দোলন করুক। আমার যতটুকু করার ছিল, সেটা কিন্তু করেছি।’
বিএনপি নেত্রীকে কারাগার থেকে বাড়িতে ফেরার সুযোগ দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বড় বোন আর ভাই, ভাইয়ের স্বামী আমার কাছে এসেছিল। আমাদের কাছে আসল যখন, খুব স্বাভাবিকভাবেই, রেহানাও আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিল। একটা মানবিক দিক থেকে আমি তাকে তার বাড়িতে থাকার, আমার এক্সিকিউটিভ পাওয়ারে যতটুকু আমি করতে পারি অর্থ্যাৎ নির্বাহী যে ক্ষমতা আছে আমি তার সাজাটা স্থগিত করে তাকে তার বাসায় থাকার অনুমতি এবং চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছি।
‘আজকে বাংলাদেশে সব থেকে দামি যে হাসপাতাল, যে হাসপাতাল সব থেকে ব্যয়বহুল সেখানেই কিন্তু তার চিকিৎসা হচ্ছে। তার ছেলের বউ তো ডাক্তার, তারেকের বউ তো ডাক্তার, শুনেছি সে নাকি অনলাইনে শাশুড়িকে দেখে। কই, ছেলে, ছেলের বউ তো কোনোদিন দেখতে আসল না। অবশ্য কোকোর বউ এসেছে, তারা তো আসেনি।’
খালেদা জিয়ার জন্মদিন প্রসঙ্গ
আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী আরও নানা প্রসঙ্গ সামনে আনেন, যার একটি হলো বিএনপি নেত্রীর জন্মদিন উদযাপন। তিনি বলেন, ‘সব থেকে বড় কথা যে ১৫ আগস্ট, খালেদা জিয়ার জন্মদিন কি ১৫ আগস্ট? জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল, তার যে ডকুমেন্ট আছে এবং সেনাবাহিনীতে কেউ যোগদান করলে তার যদি কিছু হয়, তার সম্পদের অধিকারী কে হবে, সেটা হচ্ছে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। সেই ডকুমেন্টে কিন্তু খালেদা জিয়ার জন্মতারিখ মোটেই ১৫ আগস্ট নয়। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার যে পাসপোর্ট সেখানেও তো ১৫ আগস্ট না। তার মায়ের যে বিবৃতি তাতেও তো ১৫ আগস্ট না। তার তো অনেক জন্মতারিখ।
‘সামরিক বাহিনীর যে ডকুমেন্ট সেখানে তার জন্মবছর হচ্ছে ১৯৪৪। ১৯৪৪ সালে দেখানো আছে, যখন তার বিয়ে হয়। তাহলে কি তার ১৯৪৪ সালে জন্ম হয়েছিল? না, আমি জানি না। তাহলে বিয়ের জন্য সেটা বাড়ানো হয়েছিল কি না কে জানে? অবশ্য সেটা এখন ৪৫, ৪৫ থেকে ৪৬-এ এসেছে।’
বছরের হিসাবে গড়মিল হতে পারে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আগে তো বার্থ সার্টিফিকেট থাকত না, ওটা গড়মিল হতে পারে। কিন্তু ৪/৫টা তারিখ হয় কীভাবে? কোথাও ৫ সেপ্টেম্বর, কোথাও ১৯ আগস্ট। আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে হয়ে গেল ১৫ আগস্ট। ১৫ আগস্ট জন্মদিন করে কেক কেটে উৎসব করার অর্থটা কী?’
১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের কারণ ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ওই দিন আমরা যারা বাবা, মা, ভাই হারিয়েছি, আমাদের মনে আঘাত করা। আমাদেরকে কষ্ট দেয়া। এটাই তো, এই কষ্টটা দেয়ার জন্য খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিবস পালন করে?’
এরপর বিএনপির প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছ থেকে আর কত আশা করে তারা? কীভাবে আশা করে?-সেটাই আমার প্রশ্ন।’
কোকোর মৃত্যুর পর সেই কাহিনি
২০১৫ সালে বিএনপি নেত্রীর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু পর খালেদা জিয়াকে সহানুভূতি জানাতে তার বাসায় যাওয়ার বিষয়টিও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, ‘আমি যখন রওনা হয়ে গেছি, গুলশান রোডে ঢুকছি তখন শুনলাম, তারা ওই বাড়ির মেইন গেট খুলবে না, ওই বাড়ির ভেতরে গাড়ি ঢুকতে দেবে না। আমি বললাম, এতদূর যখন চলে আসছি, ফিরে আসব কেন? পাশে নিশ্চয় পকেট গেট আছে, ওখান থেকে যাব।
‘যখনই আমার গাড়িটা বাড়ির সামনে থেমেছে, এসএসএফ-এর অফিসার যে ছিল, সে ভেতরে ছিল। উনি জাস্ট বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে আমাকে নিতে। তারা সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে তালা দিয়ে দিয়েছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে আর ঢুকতে পারিনি। আমি গেছি, একটা মা সন্তানহারা তাকে সহানুভূতি দেখাতে। আর সেখানে এইভাবে অপমান করে ফেরত দিয়েছে আমাকে।’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রসঙ্গ
বিএনপি নেতাদের প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞেস করি, তারা যে সহানুভূতি দেখাতে বলে, সহযোগিতা চায়, খালেদা জিয়া কী আচরণ করেছে? ২১ আগস্ট যে গ্রেনেড হামলা, তার আগে খালেদা জিয়ার কী বক্তব্য ছিল?
‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা কোনোদিন বিরোধী দলীয় নেতাও হতে পারবে না- এই বক্তব্যই তো খালেদা জিয়া দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১০০ বছরেও ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহর খেলা বোঝা ভার। বরং খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেনি, বিরোধী দলীয় নেতাও হতে পারেনি। এটা তারওপর ফলে গেছে।’
খালেদা জিয়া এতিমের টাকা এতিমদের হাতে পৌঁছে না দিয়ে নিজের অ্যাকাউন্টে রেখেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াই ভোগ করেছে এতিমের অর্থ। অথচ এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করো না, এটা তো আমাদের কোরান শরীফের নির্দেশ। সেই সাজা সে পেয়েছে। সেই সাজা সে ভোগ করছে।’