পুঁজিবাজার নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসিকে নিয়ে প্রতীক্ষিত বৈঠক শেষে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবার হতাশা ছড়িয়েছে। বৈঠকের ও তার আগের দিন দুই দিনে সূচক যত বেড়েছিল, একদিনেই কমে গেল তার চেয়ে বেশি। কমে গেছে লেনদেনও। যতগুলো শেয়ারের দর বেড়েছে, কমেছে তার দ্বিগুণেরও বেশি।
মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পরদিন বুধবার সকালে লেনদেনের শুরুতেই সূচক পড়ে যায় ৪০ পয়েন্টের বেশি। বেলা সোয়া ১১টার দিকে সূচক অবস্থান ফিরে পেলেও এরপর থেকে কেবলই পড়েছে। শেষ এক ঘণ্টায় পতনের গতি ছিল আরও বেশি।
শেষ পর্যন্ত সূচক কমে ৯৬.৮৫ পয়েন্ট। এক দিনেই দর হারায় ২৫৭টি কোম্পানি। এর বিপরীতে বেড়েছে কেবল ৯৭টির দর। আর দর ধরে রাখতে পেরেছে ২০টি কোম্পানি।
পতনের দিন বাজারে দাপট দেখা গেছে লোকসানি ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানির। বিপরীতে বড় মূলধনির বেশিরভাগ মৌলভিত্তির কোম্পানি দর হারিয়েছে।
সবচেয়ে বেশি দর বাড়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৭টি লোকসানি। বাকি তিনটি স্বল্প মূলধনি, যেগুলোর শেয়ার সংখ্যা খুবই কম।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ২০টি কোম্পানিকে বিবেচনায় নিলেও একই চিত্র দেখা যায়। এই ২০টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টিই লোকসানি, যেগুলোর মধ্যে বহুগুলো বছরের পর বছর কোনো লভ্যাংশ নিতে পারেনি লোকসানের কারণে।
বেলা সোয়া ১১টার পর থেকে সূচক কমেছে টানা, শেষ সময়ে পতনের গতি ছিল আরও বেশি
আগের দিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পুঁজিবাজার নিয়ে যে বৈঠক হয়, তার দিকে বিনিয়োগকারীরা তাকিয়ে ছিল দুটি ইস্যুতে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে বা বাজারমূল্যে নির্ধারণ হবে কি না, বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার বাইরে থাকবে কি না, এ নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি ঘোষণা প্রত্যাশা করছিলেন তারা।
বৈঠক শেষে এর সভাপতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং শেয়ারবাজার কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকি কমিটির আহ্বায়ক মফিজ উদ্দীন আহমেদ জানান, তারা চলতি মাস বা জানুয়ারির শুরুতে আরেকটি বৈঠক করবেন। সেই বৈঠক শেষে দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
বিএসইসি বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা দেয়া না হলেও বৈঠকে অংশ নেয়া এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, তারা এক্সপোজার লিমিট ও বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার বাইরে থাকবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের এগ্রি করা না করার বিষয় আর নেই। এটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। তাদের দিক থেকে এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা আসবে। এটি করার জন্য আইন পরিবর্তনের দরকার পড়বে। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে, এ জন্য কিছু সময় লাগবে।’
কিন্তু এই বক্তব্য বিনিয়োগকারীদের মনে চিড় ধরা আস্থা ফেরাতে পারেনি। ফলে আরও কমে যাবে আশঙ্কায় কম দামে হলেও শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে নির্ভার হতে চেয়েছে বহুজন। আর এর সুযোগ নিয়েছে অন্যরা।
সূচক পতনে প্রধান ভূমিকায় ছিল এই ১০ কোম্পানি
সূচকের পতনে প্রধান ভূমিকায় ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড, যার ৪.৩৫ শতাংশ দাম কমায় সূচক থেকে হারিয়ে গেছে ১০.৮৪ পয়েন্ট। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ওয়ালটন, যার কারণে সূচক কমেছে ৮ পয়েন্ট।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি, বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানি ও লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট, ওষুধ ও রসায়ন খাতের বেক্সিমকো ও স্কয়ার ফার্মা, বিদ্যুৎ খাতের ইউনাইটেড পাওয়ার, ব্যাংক খাতের ব্র্যাক ও টেলিকমিউনিকেশনসের গ্রামীণ ফোনের দরপতনও সূচকের অবনমনে রেখেছে প্রধান ভূমিকা।
এই ১০টি কোম্পানির কারণেই সূচক পড়েছে ৪৬.৮০ পয়েন্ট।
খাতওয়ারি বিশ্লেষণ করলে ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দর হারিয়েছে। আর্থিক, জ্বালানি, বিমা, বস্ত্র, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও হয় সবগুলো নয় প্রায় সবগুলো কোম্পানিই দর হারিয়েছে।
খাবার দিন গেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রকৌশল, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, সিমেন্ট, কাগজ, চামড়া খাতেও। কেবল খাদ্য ও আনুষঙ্গিক ও বেক্সিমকো লিমিটেড ছাড়া বিবিধ খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির দর বাড়তে দেখা গেছে।
এই ১০টি কোম্পানি সূচকে কিছু পয়েন্ট যোগ করতে পেরেছে
এর বিপরীতে বিকন ফার্মের দর ২.২৬ শতাংশ বাড়ায় সূচক ২.০১ পয়েন্ট বড়েছে। জিপিএইচ ইস্পাত, সোনালী পেপার, অ্যাপোলো ইস্পাত, বিএসসি, পদ্মা অয়েল. ম্যারিকো, এটলাস বাংলাদেশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের দর বৃদ্ধিতে সূচক অল্প বেড়েছে।
এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়াতে পেরেছে কেবল ৫.৮৫ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষে দুর্বল কোম্পানি
বুধবার দর বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল লোকসানি ফাইনফুডস। যার শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৮৯ শতাংশ। গত ১০ দিনের লেনদেনে কোম্পানিটির এমন উত্থান আর হয়নি।
লভ্যাংশ না দেয়া ফু ওয়াং ফুডসের দর বেড়েছে ৯.৬৩ শতাংশ। গত ২৪ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ার দর পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। শেয়ার দর ১৬ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮ টাকা ২০ পয়সা।
লভ্যাংশ সংক্রান্ত সভা না করা সুহিৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের দর বেড়েছে ৯.৪৪ শতাংশ। আরেক লোকসানি ফার্স্ট ফাইন্যান্সের দর বেড়েছে ৯.৩৩ শতাংশ।
লভ্যাংশ দেয়া দেশ গার্মেন্টস ছিল দর বৃদ্ধির তালিকায় পঞ্চম স্থানে। কোম্পানিটির শেয়ারের বিক্রেতা ছিল না বললেই চলে। কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৮.৬৮ শতাংশ। ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ১ লাখ ৬ হাজার ৯৫৭টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
বুধবার সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে এই ছয়টি খাতে
বছরের পর বছর ধরে লোকসানি মেঘনা পেটের দর ৮.৬১ শতাংশ, এএমসিএল (প্রাণ) এর দর ৭.৯৩ শতাংশ, লোকসানি সেন্টাল ফার্মার দর বেড়েছে ৭.৮৫ শতাংশ।
স্বল্প মূলধনি ফার্মা এইডের দর ৭.৪৯ শতাংশ, লোকসানে থেকেও লভ্যাংশ ঘোষণা করা বিচ হ্যাচারির শেয়ার দর ৭.৪৮ শতাংশ আর লোকসানে থাকা এমবি ফার্মার দর বেড়েছে ৭.৪৫ শতাংশ।
দর পতনের দশ কোম্পানি
গত ১০ দিনের লেনদেনে ৫ দিন দর হারানো দুলামিয়া কটনের শেয়ার দর সবচেয়ে বেশি কমেছে ৭.৩৮ শতাংশ। দিন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৫০ টাকা ২০ পয়সা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আরামিট সিমেন্টের শেয়ার দর কমেছে ৫.৭৮ শতাংশ। ৩৪ টাকা ৬০ পয়সা থেকে দাম কমে হয়েছে ৩২ টাকা ৬০ পয়সা।
আমরা নেটওয়ার্কের দর কমেছে ৫.৭২ শতাংশ কমে ৫২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে হয়েছে ৪৯ টাকা ৪০ পয়সা।
ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ৫.৬১ শতাংশ। কোম্পানিটির দর ১৯ টাকা ৬০ পয়সা থেকে হয়েছে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা।
ফিনিক্স ফাইন্যান্সের দর কমেছে ৫.৩৩ শতাংশ। দাম ২৮ টাকা ১০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ২৬ টাকা ৬০ পয়সা।
নতুন তালিকাভুক্ত সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের লেনদেন শুরুর পর ২৩ তম কর্মদিবসে এসে দর হারিয়েছে। ৫.০৫ শতাংশ দর হারিয়ে ৮৭ টাকা ১০ পয়সার শেয়ার হয়েছে ৮২.৭০ টাকা।
দর পতনের তালিকায় থাকা অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে ছিল প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের ৪.৮৪ শতাংশ, হামিদ ফেব্রিক্সের ৪.৮৩ শতাংশ, মালেক স্পিনিংয়ের ৪.৭৪ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ৪.৬৯ শতাংশ।
খাদ্য ছাড়া প্রধান সব খাতেই বেশিরভাগ শেয়ার দর হারিয়েছে
লেনদেনে এগিয়ে থাকা ১০ কোম্পানি
শেয়ার প্রতি ৭ টাকার বেশি দর হারালেও লেনদেনে আবার সেরা বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটির মোট ৯৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মোট ৫৮ লাখ ১৬ হাজার ২৪২টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
শেয়ারদর ১৭০ টাকা ২০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ১৬২ টাকা ৮০ পয়সা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের দর কমেছে ৮০ পয়সা। ১৯ টাকা ২০ পয়সা থেমে কমে হয়েছে ১৮ টাকা ৪০ পয়সা। ৪৪ কোটি টাকায় হাতবদল হয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৪ হাজার ২৫১টি শেয়ার।
জিএসপি ফাইন্যান্সের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকার। হাতবদল হয়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার ৫৭৮টি শেয়ার।
ওয়ান ব্যাংকের মোট লেনদেন হয়েছে ৩০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ব্যাংকটির ১ কোটি ৬৩ রাখ ৬৫ হাজার ১৮১টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের ৩৩ লাখ ২০ হাজার ৩৫১টি শেয়ার হাতবদলের বিপরীতে লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকার শেয়ার।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন হয়েছে ২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। হাতবদল হয়েছে মোট ১ কোটি ৭৭ লাখ ৯ হাজার ৩৯৫টি শেয়ার।
লেনদেন এগিয়ে থাকা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে সোনালী পেপার, ডেল্টা লাইফ ও পাওয়ারগ্রিডে।
এছাড়া ১০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৭টি। ৯ কোটি টাকার বেমি লেনদেন হয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা ছিল তিনটি।