সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা। ব্যাংকে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার লেনদেনে আগ্রহ কমছে। যান্ত্রিক জীবনে মানুষ ঝুঁকছে দ্রুত সেবাপ্রাপ্তির বিকল্প পথে। সে সুবাদে ক্রমেই বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ব্যাপ্তি।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এমন শনৈ শনৈ অবস্থার দৌড়ে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে নারীরা। এই সেবায় ছয় মাসে নারী গ্রাহকের হিসাব কমেছে ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ২১৪টি। নারী গ্রাহক কমার এই হার ৩ দশমিক ০৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মার্চে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় নারী গ্রাহক ছিল ৪ কোটি ৯৪ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪৪ জন। সেপ্টেম্বর শেষে তা কমে ৪ কোটি ৮০ লাখ ২৪ হাজার ৬৩০ জনে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে পুরুষ গ্রাহকের হিসাব সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি।
বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ, উপায়সহ দেশে বর্তমানে ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দিচ্ছে। ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’ও একই ধরনের সেবা দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির এই সেবা উল্লিখিত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এমএফএস সেবায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার কারণে অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পোশাক শ্রমিক চাকরি ছেড়ে দেশে চলে গেছেন। তাদের বড় অংশই নারী। আবার অনেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হিসাব খুললেও হয়তো লেনদেন করেননি। এ জন্য হিসাবগুলো নিষ্ক্রিয়।
তবে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হওয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। কারণ পোশাক শ্রমিকদের যে বেতন-ভাতা বাবদ কম সুদের ঋণ দেয়া হয়েছে, তার পুরোটাই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিতরণ করতে হয়। আর পোশাক শ্রমিকদের বড় অংশই নারী শ্রমিক।
কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে টানা তিন মাস কোনো ধরনের লেনদেন না হলে তা ইন-অ্যাকটিভ বা নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। আর তিন মাসের মধ্যে একটি লেনদেন হলেই তা সক্রিয় হিসেবে বিবেচিত।
লেনদেনের পরিমাণ
তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং এখন সহজ ও জনপ্রিয় একটি সেবা। ফলে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে গ্রাহকের সংখ্যা। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও।
সেপ্টেম্বর শেষে নিবন্ধিত গ্রাহক ১০ কোটি ৬৪ লাখ ৭১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ৩ থেকে ৪ কোটি হিসাবে প্রতি মাসে নিয়মিত লেনদেন হয়। এ সময় এমএফএস সেবায় ১১ লাখ ৪২ হাজার এজেন্ট যুক্ত রয়েছে।
বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন ভাতা ও পোশাক কারখানার বেতন যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে।
নগদ বাদে বাকি ১৫টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৬৫ হাজার ১৪১ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ১৭১ কোটি টাকা। আগস্টে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ২ হাজার ৭ কোটি টাকা; ওই মাসে মোট লেনদেন হয় ৬২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
দেশে এমএফএসে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকার মতো। ঘণ্টায় লেনদেনের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি।
এই সেবার মাধ্যমে টাকা জমা পড়ে (ক্যাশ ইন) ১৯ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা এবং উত্তোলন (ক্যাশ আউট) হয় ১৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। ব্যক্তি হিসাব থেকে ব্যক্তি হিসাবে পাঠানো হয় (সেন্ড মানি) ১৯ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা।
বিভিন্ন বিল পরিশোধ
মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন আর শুধু টাকা পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং এর মাধ্যমে দৈনন্দিন কেনাকাটা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ এবং মোবাইলে রিচার্জসহ নানা ধরনের সেবা মিলছে।
আবার রাজধানী ও জেলা শহরে গাড়িচালক ও গৃহপরিচারিকাদের বেতনও এখন দেয়া হচ্ছে বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো সেবা মাধ্যম ব্যবহার করে। শ্রমজীবীরাও এখন এমএফএস সেবার মাধ্যমে গ্রামে টাকা পাঠাচ্ছেন।
সেপ্টেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে কেনাকাটার বিল পরিশোধ হয়েছে ২ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা, কর্মীদের বেতন-ভাতা ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, মোবাইল ফোনের ব্যালান্স রিচার্জ ৬৫২ কোটি টাকা এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন সেবা বিল পরিশোধ বাবদ ১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। এর পরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং বাজারের সিংহভাগই বিকাশের দখলে।