পুঁজিবাজার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসিকে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের আগে কয়েক দিন পুঁজিবাজারের লেনদেন গতি হারালেও বৈঠকের দিন দিয়েছে লাফ। শেয়ারদর ও সূচক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনও বেড়েছে অনেকটাই।
১০ কর্মদিবস পর সূচক আবার ৭ হাজার পার করেছে, যেটিকে একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই বিষয়টি অবশ্য লেনদেন চলাকাছে জানা যায়নি। তবে সকাল ১০টায় লেনদেনের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে সূচক। বেলা ১১টা বাজার কিছুক্ষণ আগে সূচক বাড়ে ৭৫ পয়েন্ট। এরপরের বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত সেখান থেকে কিছুটা কমে সূচক। এরপর থেকে আবার বাড়ে।
শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে ৭০ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন শেষ হয় ৭ হাজার ৪৮ পয়েন্টে। লেনদেন হয় এক হাজার ৩৩১ কোটি ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা, যা গত ২১ নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ। সেদিন লেনদেন ছিল ১ হাজার ৭৮৬ কোটি ২৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
দিন শেষে বেড়েছে ২৭৪টি কোম্পানির শেয়ারদর, কমেছে ৬৯টির আর অপরিবর্তিত থাকে ৩২টি।
মঙ্গলবার পুঁজিবাজার নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যে বৈঠক হয়, তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যাবে বুধবার। কারণ, এই বৈঠক শেষে এর সভাপতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং শেয়ারবাজার কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকি কমিটির আহ্বায়ক মফিজ উদ্দীন আহমেদ যে বক্তব্য রাখেন, তা লেনদেনের পরেই বিনিয়োগকারীরা জানতে পারেন।
তিনি গণমাধ্যমকর্মীদেরকে বলেন, ‘ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যেসব আলোচনা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে কথা হয়েছে। এখন চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরও একটি বৈঠক করতে হবে। সেটি চলতি মাসে অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে হবে।… ওই বৈঠকে পুঁজিবাজারের জন্য দৃশ্যমান কিছু দেখা যাবে।’
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনা পদ্ধতি আর বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার বাইরে থাকবে কি না- এ নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এগুলো খুবই সেনসিটিভ ইস্যু। এ ব্যাপারে এখনই কোনো কথা বলতে চাইছি না। এর জন্য আপনাদেরকে পরবর্তী বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের দিন শুরুতে সূচক বেড়ে পরে কমলেও শেষ সময়ে আবার ক্রয়চাপ দেখা দেয়
আড়াই মাস ধরে দর সংশোধনে থাকা পুঁজিবাজারে সম্প্রতি টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয় বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে বিরোধ ইস্যুতে।
গত ৩০ ডিসেম্বর দুই পক্ষের বৈঠকের পর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা যা এক্সপোজার লিমিট ও বন্ডে বিনিয়োগ নিয়ে মতভিন্নতার অবসানের আশা তৈরি হয়।
সেই বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেউ বক্তব্য না দিলেও বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ জানান, শেয়ারের ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার লিমিট গণনা ও বন্ডে বিনিয়োগ ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখার বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। তারা নীতিগতভাবে এসব বিষয়ে একমত হয়েছেন।
পরদিন পুঁজিবাজারে হয় উত্থান। এক দিনেই সূচক বাড়ে ১৪৩ পয়েন্ট। তবে সেদিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক বিজ্ঞপ্তিতে তৈরি হয় উদ্বেগ।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএসইসি কমিশনারের বরাত দিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সেসব সঠিক নয়।
এই খবরে বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসে লেনদেন শুরুই হয় ৮৪ পয়েন্ট পতনের মধ্য দিয়ে। তবে এ সময় তার আগের রাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশ তুমুল আলোচনা তৈরি করে, ঘুরে দাঁড়ায় বাজার। শেষ পর্যন্ত লেনদেন শেষ হয় ৮৯ পয়েন্ট সূচক বাড়ার মধ্য দিয়ে।
ওই বিকেলে রাজধানীতে এক আলোচনায় বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারের যে আন্তরিকতা আছে, তা প্রকাশ হবে সামনের কিছু দিনে।
এসব ঘটনার পর শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিতে যায় পুঁজিবাজার। এই সময়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা আলোচনা, পর্যালোচনা, তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়। বাজার নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কী আসছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান পাল্টাবে কি না, বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হবে- এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে থাকে পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে।
কিন্তু এই বৈঠকে কী হয়, তা নিয়ে সংশয়ে কমে যায় লেনদেন। দুই দিনই সূচক বাড়লেও লেনদেন একেবারেই কমে যায়। দুই দিনই নয়শ কোটি টাকার কম শেয়ার হাতবদল হয়। এতে স্পষ্ট হয় বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে না গিয়ে হাত গুটিয়ে আছেন।
বৈঠকের দিন হাত গুটিয়ে রাখা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনেকেই সক্রিয় হয়েছেন, এটা স্পষ্ট।
লেনদেন ও সূচকে ভূমিকা যেসব কোম্পানি ও খাতের
খাত হিসেবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আর্থিক, বস্ত্র, প্রকৌশল, সিমেন্ট খাতে প্রায় সব কোম্পানির দর বেড়েছে। ভালো দিন গেছে ব্যাংক, বিমা ওষুধ রসায়ন, তথ্য প্রযুক্তি, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতেও।
লেনদেনে আবার সেরা ব্যাংক খাত। এর পরের অবস্থান যথাক্রমে ওষুধ ও রসায়ন, বিবিধ, বস্ত্র, আর্থিক ও বিমা খাত। মোট পাঁচটি খাতে লেনদেন হয়েছে একশ কোটি টাকার বেশি।
সূচক বাড়াতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে এই ১০টি কোম্পানি
শেয়ারদর সবচেয়ে বেশি না বাড়লেও সূচক বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকায় ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটির শেয়ার দর ২.১ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৫.৫৬ পয়েন্ট। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট, যার দর ২.৮২ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৪.৬৩ পয়েন্ট।
সূচকে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ করেছে, এমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে উইনাইটেড পাওয়ার, আইসিবি, বেক্সিমকো ফার্মা, গ্রামীণ ফোন, বার্জার পেইন্টস, ওয়ান ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মা ও লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ২৯.০৮ পয়েন্ট।
বাজারে ভালো দিনেও শেয়ারদর কমেছে ওয়ালটনের, যার দর ০.৩৬ শতাংশ কমায় সূচক থেকে হারিয়েছে ২.৩৬ পয়েন্ট।
এ ছাড়া রবি, শাহজিবাজার পাওয়ার, ফরচুর সুজ, সোনালী পেপার, আমান ফিড, পদ্মা অয়েল. ডেল্টা লাইফ, ইউনিক হোটেল, ও উত্তরা ব্যাংকও সূচক কমিয়েছে। তবে দরপতনের হার খুব একটা বেশি না হওয়ায় সূচকে প্রভাব পড়েছে কমই।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৭.১৩ পয়েন্ট।
বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির দিন সূচক কিছুটা হলেও কমিয়েছে এই কোম্পানিগুলো
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
এই তালিকার প্রথম তিনটিই লোকসানি কোম্পানি, যেগুলোর দর বেড়েছে সমান ১০ শতাংশ করে। তিনটি কোম্পানিই লোকসানের কারণে এবার লভ্যাংশ দেয়নি আর এরপর ক্রমেই দর হারাচ্ছিল। এই তিনটির মধ্যে দুটির আবার গত এক যুগের লভ্যাংশ দেয়ার ইতিহাস নেই।
কোম্পানিগুলো হলো খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, মেঘনা পেট ও মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক।
এর মধ্যে খাদ ব্রাদার্সের দর, যার দর বেড়েছে ১০ শতাংশ। শেয়ার দর ১১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১২ টাকা ১০ পয়সা। মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের দর ১৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা আর মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজের দর ১৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা ৯০ পয়সা।
বেশ কিছুদিন পর পাঁচটি খাতে একশ কোটি টাকার বেশি লেনদেন দেখা গেল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির তালিকার বাকি ৭টি কোম্পানির দরও বেড়েছে একদিনে যত বাড়া সম্ভব ততই। এগুলো হলো ওটিসিফেরত তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল, নতুন তালিকাভুক্তি সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্স, মুনাফায় থাকার পরেও লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর ক্রমেই দর হারানো ফুওয়াং ফুড, অ্যাপোলো ইস্পাত, ডেল্টা স্পিনার্স, ফাইন ফুডস ও জিএসপি ফাইন্যান্স।
আরও ৯টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায়।
আরও পাঁচটি কোম্পানির দর ৮ শতাংশের বেশি, ৬টি কোম্পানির দর ৭ শতাংশের বেশি, ৭টি কোম্পানির দর ৬ শতাংশের বেশি, ১০টি কোম্পানির দর ৫ শাতংশের বেশি, ২১টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ১৭টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ৫২টির দর ২ শতাংশের বেশি, ৭৩টির দর বেড়েছে ১ শতাংশের বেশি।
দর পতনের শীর্ষ ১০
যেগুলোর দর কমেছে, সেগুলোর দর শতকরা হারে খুব বেশি কমেনি। এই তালিকার শীর্ষে থাকা আমান ফিড দর হারিয়েছে ৩.৫৭ শতাংশ। এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এশিয়ার ইন্স্যুরেন্স দর হারিয়েছে ৩.০৬ শতাংশ।
শেয়ারদরের পাশাপাশি লেনদেন বেড়েছে বেশিরভাগ খাতেই
জিবিবি পাওয়ার, ইনডেক্স অ্যাগ্রো, ফরচুন সুজ, ওরিয়ন ইনফিউশন, দেশ গার্মেন্টস, সোনলী পেপার, শাহজিবাজার পাওয়ার দর হারিয়েছে ২ শতাংশের বেশি। আর তালিকায় ১০ নম্বরে থাকা স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স দর হারিয়েছে ১.৮৯ শতাংশ।
দর হারানো বাকি কোম্পানিগুলোর মধ্যে আরও ১৫টি দর হারিয়েছে ১ শতাংশের বেশি, বাকিগুলোর দর কমেছে এক শতাংশের কম।
লেনদেনে সেরা যেগুলো
লেনদেনের এগিয়ে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটির মোট ১৩০ কোটি ১৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। হাতবদল হয়েছে মোট ৭৬ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫১টি।
একশ কোটি টাকার লেনদেনের ঘরে ছিল ওয়ান ব্যাংকও। ৫ কোটি ৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৪১টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১০০ কোটি ১১ লাখ টাকায়।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা জিএসপি ফাইন্যান্সের শেয়ারে লেনদেন হয়েছে ৪৩ কোটি ১৩ লাখ টাকার। হাতবদল হয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার ৫৭৯টি শেয়ার।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা পাওয়ার গ্রিডে লেনদেন হয়েছে ৩১ কোটি ৩১ লাখ টাকার। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৫১ লাখ ৩ হাজার ২৫১টি।
পঞ্চম স্থানে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ১ কোটি ৮৭ লাখ ৮৮ হাজার ৮১টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যার বাজারমূল্য ছিল ২৮ কোটি ৭ লাখ টাকা।
এছাড়া প্যারামাউন্ড টেক্সটাইলের ২৭ কোটি ৫১ লাখ, ডেল্টা লাইফে ২৫ কোটি ৭২ লাখ, অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালে ২৪ কোটি ২ লাখ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকে ২২ কোটি ১৯ লাখ টাকা, জিপিএইচ ইস্পাতে ২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে লেনদেনে শীর্ষ ১০ কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে ৪৫৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৩৪.০৭ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া ২০টি কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ৬১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৪৬.১০ শতাংশ।