বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদের’ প্রভাবে সৃষ্ট বৈরি আবহাওয়ায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমন ওঠার এই সময়ে ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি অনেক এলাকার ধান গাছ মাটিতে পড়ে গেছে। ক্ষেতে পানি জমে শীতের সবজিও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে সোমবার। তবে নিম্নচাপের প্রভাবে রোববার থেকেই থেমে থেমে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়। সোমবার সারা দিন এই বৃষ্টি ছিল।
টানা দুই দিনের বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো বাতাসে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা তাই কৃষকদের। এরই মধ্যে অনেক এলাকায় ফসলের বেশ ক্ষতি হয়েছে। তবে বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
নিউজবাংলার বরগুনা, পটুয়াখালী ও রাজবাড়ি জেলা প্রতিনিধির পাঠানো খবর-
বরগুনা: উপকূলীয় জেলা বরগুনার অনেক এলাকায় এরই মধ্যে নুয়ে পড়েছে আমন ধান। ক্ষেতে পানি জমায় ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন এখানকার কৃষকরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের (খামার বাড়ি) তথ্যমতে, বরগুনায় এ বছর ৯৮ লাখ ৮০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে।
কৃষিবিভাগ জানিয়েছে, উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের প্রধান ফসল রোপা আমন। বিভিন্ন এলাকার মাটির ধরন অনুযায়ী জেলার ৫৫ ভাগ জমিতে বিআর, ব্রি ও বিনা এই তিন জাতের উফশী আবাদ হয়েছে। বাকি ৪৫ ভাগ জমিতে স্থানীয় জাতের রোপা আমনের আবাদ হয়েছে।
কৃষকরা জানান, তিন দিনের বৃষ্টি ও বাতাসে হেলে পড়েছে ধান গাছ। মাঠে পানি জমায় ওই ধান পচে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
ঝোড়ো বাতাসে নুয়ে পড়েছে ক্ষেতের ধান গাছবরগুনা সদর উপজেলার ক্রোক বৈঠাকাটা এলাকার কৃষক আলম মিয়া জানান, ‘মুই এই বচ্ছর চাইর একর জমিনে রোপা আমন আবাদ করছি। গত দুই দিনের দেওই আর বাতাসে মোর জমির এক তিনের দুই ভাগ ধান সব মাডিতে পইর্যা গ্যাছে।’
একই অবস্থা ওই এলাকার কৃষক শাহজাহান, মজিদ, আফজাল, কুদ্দুস ও কামালসহ প্রায় সব আমনচাষির।
পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়নের কৃষক আইয়ুব আলী হাওলাদার বলেন, ‘গত কয় দিনের দেওই আর বাতাসে মোর খ্যাতের অর্ধেক ধান নুইয়া মাডিতে পইর্যা গ্যাছে। পানি জইম্মা গ্যাছে কোলায় (গোড়ায়)। এহন হেই পানতে ধান হুইয়া পইর্যা নষ্ট অইয়া যাইতে আছে।’
তালতলীর নিশানবাড়িয়া এলাকার আবদুল হক মিয়া বলেন, ‘মোগো এই ধানই মেরুদণ্ড। ধানে কেবল পাইক্কা আইছে এই সোমায় মোর ধানগুলা বেবাক খ্যাতে হুইয়া পড়ছে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, ‘আমন মৌসুমে রোপা আমনের ধান পোক্ত হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ধান কাটা শুরু হবে। এ অবস্থায় জাওয়াদের প্রভাবে ধান গাছ মাটিতে হেলে পড়েছে।
‘এতে কিছু ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, তবে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমরা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে ধানগাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও মাঠের পানি অপসারণের পরামর্শ দিচ্ছি।’
এদিকে জাওয়াদের প্রভাবে সোমবার বিকেল পর্যন্ত বরগুনায় গুঁড়িগুঁড়ি ও হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে বেড়েছে শীতের তীব্রতাও।
এতে ভোগান্তিতে পড়েছে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও নিম্নআয়ের সাধারণ মানুষ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সারা দিন বৃষ্টিপাত হতে পারে দেশের অনেক জায়গায়। মঙ্গলবার থেকে দেশের বেশিরভাগ এলাকার আকাশ পরিষ্কার হতে থাকবে। আগামী দুই-এক দিন পর থেকে বাড়বে শীতের প্রকোপ।পটুয়াখালী: জেলায় আমন, ডাল ও তরমুজের ক্ষতির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
ক্ষেতের জমানো পানি নেমে গেলে অবশ্য তেমন একটা ক্ষতি নাও হতে পারে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক একেএম মহিউদ্দিন। সোমবার সকাল থেকে কলাপাড়া ও গলাচিপার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা বলেন।
মহিউদ্দিন জানান, জেলায় এবার ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হলেও এরই মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমির ধান ঘরে তুলেছেন কৃষকরা। বাকি যে আমন মাঠে রয়েছে তার মধ্যে শুধু দেশি জাতের ধান বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তা ছাড়া বেড়িবাঁধের বাইরে যে সব এলাকায় পাকা ফসল ক্ষেত রয়েছে সেখানে পানি জমলে ক্ষতি হতে পারে। তারমতে, এ অঞ্চলের জমিতেই খুব একটা পানি জমে না, এ জন্য আমনের তেমন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এ কৃষি কর্মকর্তা অবশ্য খেসারি ডালের ভালো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তিনি জানান, জেলায় এ বছর ৪ হাজার হেক্টর জমিতে খেসারি ডালের আবাদ হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হতে পারে। আগামী দুই-এক দিনেরও বৃষ্টি হলে এ ক্ষতি হতে পারে বলে শঙ্কা তার।
তবে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ডালে তেমন ক্ষতি হবে না বলে দাবি করেন তিনি।
ক্ষেতে পানি জমায় শঙ্কা দিয়েছে চারা নষ্ট হওয়ারমহিউদ্দিন আরও জানান, রাঙ্গাবালী ও কলাপাড়ার চাষিরা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম তরমুজ চাষ করেছেন। এর মধ্যে গত দুই দিনে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিতে তরমুজ গাছের ক্ষতি হয়েছে।
বিশেষ করে বেড়িবাঁধের বাইরের অনেক স্থানে বীজ নষ্ট হবার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আগামী দুই-এক দিন না গেলে বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতির হিসাব বের করা সম্ভব না বলে জানান তিনি।
জেলা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক মাসুদ রানা জানান, সোমবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পটুয়াখালীতে ২৯ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আরও ২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও জেলায় ভারী বর্ষণের আভাস রয়েছে।
রাজবাড়ী: টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে রাজবাড়ীতে পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আমন ও শীতকালীন ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
সোমবার সদর উপজেলার রামকান্তপুরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ক্ষেতে কেটে রাখা পাকা ধান পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়া বাঁধাকপি ও ফুলকপি ক্ষেতে পানি জমে গেছে।
সদরের রামকান্তপুরের কৃষক কলি শেখ জানান, দুই দিন আগে পাকা ধান কেটে জমিতে রেখেছিলেন শুকানোর জন্য। এরপর থেকেই বৃষ্টি হওয়ায় ক্ষেতের সব ধান পানিতে ডুবে গেছে। এতে ধান ঘরে তুলতে পারবেন কি না এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এই ধান দুই-এক দিনের মধ্যে ঘরে তুলতে না পারলে এখানেই নষ্ট হয়ে যাবে। আমার ২ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সারা মৌসুমের কষ্ট বৃথা যাচ্ছে।’
একই এলাকার কৃষক দেনেশ নারায়ন জানান, তিনিও ৩ দিন আগে ধান কেটে আটি বাঁধার জন্য জমিতে রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু বৃষ্টিতে ৩ বিঘা জমির পাকা ধান এখন পানির নিচে। এতে সব ধান নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে ভয় তার।
শীতকালীন সবজি চাষি বক্কার শেখ জানান, তার ফুলকপি ক্ষেতে পানি আটকে আছে। গাছগুলো এরই মধ্যে নেতিয়ে পড়েছে। গাছগুলো মরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তার।
দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষ জেলারগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছে রাজবাড়ী। এ বছর জেলায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের বীজ রোপন করা হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে এখন দুশ্চিন্তায় জেলার পেঁয়াজ চাষিরা।
জেলা কৃষি অফিস থেকে জানা যায়, জেলায় এ বছর প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সবজি রয়েছে, যেখানে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উপপরিচালক এসএম শহীদ নূর আকবর জানান, তাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করেছেন। বৃষ্টি শেষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। তবে এরই মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি কিছু তথ্য মিলেছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বরগুনা প্রতিনিধি রুদ্র রুহান, পটুয়াখালী প্রতিনিধি জাকারিয়া হৃদয় ও রাজবাড়ী প্রতিনিধি রবিউল আউয়াল।