তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন করে তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর’ ও ‘বর্ণবাদী’ মন্তব্য করে আগে থেকেই তীব্র সমালোচনার মধ্যে আছেন এই প্রতিমন্ত্রী।
নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর’ ও ‘বর্ণবাদী’ মন্তব্য নিয়ে সমালোচনাকে গায়ে না মাখার কথা রোববার নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী মুরাদ। তবে রাতে এক ফেসবুক লাইভে তার উপস্থিতিতেই আপত্তিকর শব্দের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন নাহিদ রেইনস নামে এক ইউটিউবার ও ফেসবুকার।
তবে চলচ্চিত্র অভিনেতা ইমন ও অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির সঙ্গে আলাপচারিতার ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই ফোনালাপের সত্যতা নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন অভিনেতা ইমন।
গত ১ ডিসেম্বর রাতে ‘অসুস্থ খালেদা, বিকৃত বিএনপির নেতাকর্মী’ শিরোনামে এক ফেসবুক লাইভে যুক্ত হন মুরাদ হাসান। লাইভটির সঞ্চালক ছিলেন নাহিদ রেইনস নামে এক ইউটিউবার ও ফেসবুকার।
লাইভে বিএনপির রাজনীতির সমালোচনার একপর্যায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি এবং দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করেন। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্ম ও পরিবারের সদস্যদের নিয়েও কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রীর এসব মন্তব্যকে ‘কুরুচিপূর্ণ’, ‘অশালীন’ ও ‘মর্যাদাহানিকর’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা।
এসব মন্তব্য ও তীব্র সমালোচনা নিয়ে রোববার দুপুরে প্রতিমন্ত্রী মুরাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, এসব তিনি পাত্তা দিচ্ছেন না। তবে রাতেই তিনি নিজের অবস্থান পাল্টান। নাহিদ রেইনসের সঙ্গে রোববার রাতে আবারও লাইভে যুক্ত হন মুরাদ।
লাইভে প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেন নাহিদ রেইনস।
এ সময় নাহিদ রেইনস বলেন, ‘ফর ফিউ সেকেন্ডস তারেক রহমানের কন্যাকে নিয়ে আমাদের কনভারসেশন ছিল। আপনি (মুরাদ) তখন কমেন্ট করছিলেন একজন অপরাধীর ফ্যামিলির মেম্বারদের নিয়ে।’
সেই ‘এক-দুই সেকেন্ডের কনভারসেশনকে’ ব্যবহার করে অনেকে আন্দোলন প্রতিবাদ করছেন বলে অভিযোগ করেন সঞ্চালক নাহিদ।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটা বলতে পারি যে, কেউ যদি ওই কনভারসেশনে মুরাদ ভাইয়ের কথায়, ইনফ্যাক্ট আমার কথায়ও কেউ যদি হার্ট হয়ে থাকেন সেটা যে কোনো অরগানাইজেশন হোক, কোনো মানুষ হোক, হু এভার ইট ইজ, আপনারা ভুল বুঝেও যদি হার্ট হয়ে থাকেন, দেন আই অ্যাম স্যরি, উই আর স্যরি ফর দ্যাট।’
এ সময় মাথা নেড়ে নাহিদের কথার সমর্থন জানান ডা. মুরাদ হাসান।
রোববার রাতের লাইভে এসে জাইমা রহমানকে নিয়ে আপত্তিকর কোনো মন্তব্য করেননি বলেও দাবি করেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কোনো কন্যাসন্তানকে নিয়ে, কোনো মাকে নিয়ে, কোনো বোনকে নিয়ে কোনো প্রকার কুরুচিপূর্ণ বা অশ্রাব্য বা শ্রুতিকটু শব্দ ব্যবহার আমি করি নাই, এটা করতেও চাই না।’
সরাসরি না বললেও প্রতিমন্ত্রীর ইঙ্গিত ছিল সম্পাদনার কারসাজিতে তার বক্তব্য বিতর্কিত করা হয়েছে।
মুরাদ হাসান বলেন, ‘ইদানীং কেউ কেউ ভালো ফটোশপ করতে পারেন, এডিটিং করতে পারেন। আমার বিরুদ্ধে একটি বিরাট বলয় কাজ করছে, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে না, বহন করে না।’
জাইমা রহমানকে নিজের মেয়ের সঙ্গে তুলনা দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জাইমা রহমানকে পারসোনালি অ্যাটাক করা বা তাকে সরাসরি জড়িয়ে কোনো কথা বলার মানসিকতা আমি পোষণ করি না। তার বয়স এবং আমার নিজের মেয়ের বয়স একেবারে কাছাকাছি। তো আমার কন্যা সমতুল্য একজন মেয়েকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য করার, মন্তব্য করার কোনো মানসিকতা পোষণ করি না।’
এ সময় নারীবাদীদেরও আক্রমণ করেন মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আবার কেউ কেউ অতিরিক্তি নারীবাদী ভাব। তারা যেন আমাদের মায়েদের, আমাদের বোনদের, আমাদের নারী সমাজকে কিনে ফেলেছে।’
ফোনালাপে নতুন তোপ
রোববার রাতে প্রতিমন্ত্রীর লাইভ প্রচারের সময় চলচ্চিত্র অভিনেতা ইমন ও অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির সঙ্গে তার একটি ফোনালাপ ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ‘ধর্ষণের হুমকি’ দেয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। তার বক্তব্যজুড়ে ছিল অজস্র অশালীন শব্দ।
এই ফোনালাপ ঘিরে ফের তোপের মুখে পড়েছেন মুরাদ হাসান। ফোনালাপের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন অভিনেতা ইমন।
তিনি সোমবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা আমার কণ্ঠ এবং এটা আমি।’
নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ইমন বলেন, ‘এমন পর্যায় থেকে ফোন এলে আর কী করার থাকে। তার পরও আপনার শুনে থাকবেন, আমি ফোন ধরছিলাম না, দেরি করে ফোন ধরেছি।’
ফোন ধরতে দেরি করাকে অনেকটা এড়িয়ে চলার কৌশল বলেই ইঙ্গিত করেন ইমন। তিনি বলেন, ‘এটা অনেক কিছুর ইঙ্গিত করে।’
এই ফোনালাপ কবেকার সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান ইমন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কখন, কবে এ ফোনের ঘটনা মনে নেই এখন। সম্ভবত শুটিংয়ে ছিলাম বা শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
কথোপকথনের সময় নির্দিষ্ট করে বোঝা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতার ঘটনাটি গত বছর ইমন-মাহি অভিনীত এবং ওয়াজেদ আলী সুমন পরিচালিত ব্লাড চলচ্চিত্রের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সময়ের।
মুরাদের ফোন বন্ধ
ফাঁস হওয়া ফোনালাপ এবং ফেসবুকে সবশেষ লাইভ নিয়ে মুরাদ হাসানের বক্তব্য জানতে সোমবার সকাল থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা।
তবে বেলা দেড়টা পর্যন্ত তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। বেলা আড়াইটার দিকে তার ফোন খোলা পাওয়া যায়, কিন্তু কয়েকবার কল করা হলেও তিনি কেটে দেন। এরপর প্রতিমন্ত্রীর মোবাইল ফোনটি আবার বন্ধ পাওয়া গেছে।
জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সোমবার বেলা সাড়ে ৩টায় বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি করা হয়েছিল প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে। তবে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলেও সেখানে যাননি প্রতিমন্ত্রী। ফলে তাকে ছাড়াই অনুষ্ঠান শুরু করেন আয়োজকরা।
এদিকে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বক্তব্যের ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির আইনজীবী খন্দকার রেজা ই রাকিব।
এই আইনজীবী সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত যখনই কোনো নির্দেশনা দেয়, বিটিআরসি সেটাকে সিরিয়াসলি অ্যাড্রেস করে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্য সব প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যোগাযোগ করে নামানোর জন্য যা যা করার দরকার, তারা তা করে।’
তবে সব সময় আদালতের সিদ্ধান্তেই কন্টেন্ট সরানো হয়, বিষয়টি তেমন নয় বলেও জানান রেজা।
তিনি বলেন, ‘বিটিআরসির বিভিন্ন কমিটি আছে। ল এনফোর্সের কিছু এজেন্সিও আছে। তারাও এসব জিনিস দেখে। বিটিআরসির কাছে টাইম টু টাইম তারা জানায়। তখন বিটিআরসি অ্যাকশন নেয়।’