বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভাইরাল হওয়ায় গতি মারুফের, সঙ্গীদের কী হবে

  •    
  • ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৯:১১

রাজধানীর পুরান ঢাকায় বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় থাকত মারুফ। সেই পার্ক, কোর্টকাচারি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সদরঘাটসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মারুফের মতো অনেক পথশিশুরাই ঘুরে বেড়ায়। তারাও পার্ক বা ফুটপাতে ঘুমায়। কেউ খাবার দিলে খায়, আবার অনেক সময় চেয়ে নিয়ে খায়। তাদের কাউকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি।

ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় পথে পথে ঘুরত শিশু মারুফ। হয়ে যায় মাদকে আসক্ত। একটি সংবাদমাধ্যমের লাইভে ঢুকে ‘লকডাউন ভুয়া’ বলার পর তাকে নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। এরপর তাকে উদ্ধার করে নিরাময় শেষে মাকে খুঁজে তুলে দেয়া হয় তার কাছে।

শিশুটি এখন মাতৃস্নেহে সিক্ত। সরকারি আশ্রয় থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় মামা কথা দিয়ে যান, তার ভাগ্নেকে স্কুলে ভর্তি করবেন।

মারুফকে উদ্ধার করে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ আরও একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করে দিয়েছে তাদের কর্তব্যনিষ্ঠার প্রতি।

মারুফকে নিয়ে গেলেও তার মতোই আরও যে শিশু আছে, যারা পরিবারের বাইরে একা একা পথে ঘুরে বেরিয়ে মাদকে আসক্ত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় হচ্ছে, তাদের বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর পুরোপুরি উদাসীন।

রাজধানীর পুরান ঢাকায় বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় থাকত মারুফ। সেই পার্ক, কোর্ট কাচারি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সদরঘাটসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মারুফের মতো অনেক পথশিশুরাই ঘুরে বেড়ায়। তারাও পার্ক বা ফুটপাতে ঘুমায়। কেউ খাবার দিলে খায়, আবার অনেক সময় চেয়ে নিয়ে খায়।

ডান্ডি নামক এক প্রকার মাদকে আসক্ত বেশির ভাগ। মারুফের মতো নেশা বা টাকা-পয়সা নিয়ে প্রায়ই মারামারি করে।

তারা বলছে তাদেরকে কেউ এসে মাদক দিয়ে যায়। তবে কে বা কারা তাদের মাদক দেয় তারা তা বলতে পারে না।

এদের অনেকেরই বাবা-মা নেই। কেউ ভাই বা বোনের সঙ্গে থাকে। কেউ কারও সঙ্গে থাকতে থাকতে তাকেই ভাই বোন বানিয়ে নিয়েছে। এই শিশুদেরকে ব্যবহার করে মাদক বিক্রি করা হচ্ছে, কখনও কখনও ভিক্ষাও করানো হচ্ছে এদেরকে দিয়ে।

পার্কের বেদিতে ডান্ডি নামক মাদক সেবন করছিল ‘আ’ আদ্যাক্ষরের ৭ থেকে ৮ বছর বয়সী এক ছেলে।

কেন খাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বলে, সবাই খায়, তাই সেও খায়।

বুদ্ধি হওয়ার পর বাবা-মাকে দেখেনি ছেলেটা। থাকে বোনের সঙ্গে। মানুষের কাছে খাবার চেয়ে খায়।

তার পাশে বসে ছিল আরও তিনটি শিশু। তাদের জীবন ও বক্তব্যও অনেকটা একই ধরনের। পড়াশোনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘এসব বড়লোকের পুলাপাইন করে। আমরা করি না।’

এই শিশুদের মধ্যে একজন পথচারী দেখলেই হাত পাতছিল। জানায়, তার বাবাও ভিক্ষা করে, মা নেই। ছোট ভাইকে নিয়ে ভিক্ষা করে দুই বেলা খায়।

পড়াশুনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘গেছিলাম, হেরা আটকাইয়া রাখে; ভালো লাগে না; সাইন দিয়া আইয়া পড়ছি।’

সেই পথশিশু মারুফ

কেন শুধু মারুফ

মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে মূলেই গলদ। আসলে এসব পথশিশুরা যখন একটা অপরাধ করে বসে তখন পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর সবাই নড়েচড়ে বসে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কথিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্বলতাই লক্ষ্য করি।’

তিনি বলেন, ‘মারুফ যখন আলোচিত হয়, তখন সবাইকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। রাষ্ট্রের এটা দায়িত্ব, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কখনও কখনও এসব বিষয়ে ২-১ টি পদক্ষেপ দেখলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। যে কারণে এইসব পথশিশুদের আশ্রয়কেন্দ বা পুনর্বাসনে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা হয় না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও অমানবিক।’

‘সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি উদ্যোগ এই শিশুদের নিয়ে কাজ করে। মারুফকে উদ্ধার থেকে শুরু করে পুনর্বাসন ও স্বজনদের হাতে তুলে দেয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা পারভেজ হাসান তরুণ পারভেজ হাসান।

নিউজবাংলাকে তিনি, ‘মারুফ ভাইরাল হয়েছে দেখে নিয়েছি সেটা নয়। মারুফ অসহায় ছিল, তার পাশে দাঁড়ানোর মতো ওই সময় কেউ ছিল না। আমরা অন্যান্য পথশিশুদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। যেকোনো পথশিশু যদি আলোর পথে ফিরতে চায়, তাকে সহযোগিতা করি। আর এই দায়িত্ব কারও একার নয়, সবার।’

জানতে চাইলে ঢাকা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রুকনুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সরাসরি কোনো পথশিশুকে ধরতে পারি না। এটা করতে পারে পুলিশ। তারা আমাদের কাছে ধরে এনে দেয়, তখন আমরা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তাদেরকে (পথশিশুদের) সংশোধনাগারে দিয়ে দেই।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) শহীদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পথশিশুদের নিয়ে আমাদের একটি প্রজেক্ট রয়েছে। আমরা পথশিশুদের সংশোধনাগারে পাঠানো এমনকি তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া এসব কাজ করি। আমাদের বিভাগেই এ ধরনের কাজ রয়েছে। আমরা এসব কাজের পরিধি আরো বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’

পথশিশুদের নিয়ে চাইল্ড সেনসেটিভ স্যোসাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পটির পরিচালক সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কিছু ক্যাম্প রয়েছে (সদরঘাট, গাবতলী)। এছাড়াও আমাদের কিছু সমাজকর্মী রয়েছে। আমাদের একটি জরুরি সেবা নম্বর (১০৯৮) রয়েছে। সেখান থেকে সংবাদ পেলে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনে আমরা সেইসব পথশিশুদের প্রথমে সংগ্রহ করি। তারপর তাদের সংশোধনাগারে পাঠাই।

‘তাদের বাবা-মা যদি পাওয়া যায় বা তারা যদি আগ্রহী হয়, তখন আমরা তাদেরকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। কোনো শিশু যদি আইন ভঙ করে ফেলে, তখন তাদেরকে গাজীপুরে কোণাবাড়ির দুটি বা যশোরের সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। সংশোধনাগারে তাদেরকে কাউন্সেলিং করা হয়। এরপর তারা যখন বলে আমরা বাড়িতে ফিরতে চায়, তখন আমরা ব্যবস্থা করি।’

ভাসমান শিশু কত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকায়।

অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। ঢাকার হিসাব অবশ্য তাদের কাছে নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই ছয় লাখ পথশিশু রয়েছে।

সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের পারভেজ হাসান বলেন, ‘এদের অধিকাংশ বসতবাড়িহীন, পোশাকহীন, রাস্তায় থাকে। এদের আবার বেশির ভাগ মাদকাসক্ত। এদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘এদের জীবনটাই করুণ। তারা ছোটবেলা থেকে বিরূপ চিত্র দেখে বড় হয়েছে। তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রয়োজনটা পূরণ করতে হবে। যেমন: খাবার, পোশাক, থাকার ব্যবস্থা। যাতে তারা মনে করে পিছনে যা হওয়ার হয়েছে, সামনে ভালো কিছু হবে।’

পুরান ঢাকা এলাকায় পথশিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লিডো)।

এর টিম লিডার আরিফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদের এখানে অনেক শিশুই থাকছে, পড়াশোনা করছে, কিন্তু অনেকেই থাকতে চায় না। আমরা চেষ্টা করি তাদের পূর্বের জীবনকে ভুলিয়ে নতুন পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে। যতটুকু সম্ভব তাদেরকে নিয়ে আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রাম করার চেষ্টা করি।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিপ্রা সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিবারের ভাঙনের কারণেই কিন্তু একজন পথশিশু তৈরি হচ্ছে। সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এই বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা প্রয়োজন। তারপর তা রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘এখন অনেক পথশিশুই মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পরিবার থেকে বের হয়েই কিন্তু একটা শিশু মাদক ধরে না। এই জায়গায় সমাজ, রাষ্ট্রের তাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা জরুরি। তাদের জন্য ভালো পরিবেশের পুনর্বাসনের জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর