বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মাটির ওপর অত্যাচারে হুমকিতে প্রাণ-প্রকৃতি

  •    
  • ৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৯:৪১

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির অপরিকল্পিত ও অনিয়মতান্ত্রিক ব্যবহারে বাড়ছে পরিবেশগত বিপর্যয়। এটি মানবজাতিকে ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আমাদের খাদ্য, অক্সিজেনসহ অনেক নিত্য প্রয়োজন মেটানো গাছের জন্ম মাটি থেকে। এটি থাকা না থাকার ওপর নির্ভরশীল প্রাণের অস্তিত্ব। অথচ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পদের ব্যবহারে চরম উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনা দেখিয়েছে মানুষ। এর ফলে প্রাণ ও প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, মাটির অপরিকল্পিত ও অনিয়মতান্ত্রিক ব্যবহারে বাড়ছে পরিবেশগত বিপর্যয়। এটি মানবজাতিকে ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিবেশগত বিপর্যয়ের চাপে আমরা খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছি। প্রকৃতিগতভাবে আমাদের নাভিশ্বাস বাড়ছে। কারণ মাটির ব্যবহার আসলে নিয়মতান্ত্রিক হচ্ছে না। আবার ভূমণ্ডলে মাটির আকারও বাড়ানো সম্ভব না। অথচ ক্রমাগত মানুষ বাড়ছে। এর মানে হচ্ছে সীমাবদ্ধ ভূমিতে ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপ তৈরি হচ্ছে এবং নানামাত্রিক ব্যবহারে জমির চাহিদা বাড়ছে।

‘নগরব্যবস্থা গড়ে উঠছে; রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ বাড়ছে। এতে ব্যবহারযোগ্য জমি বা মাটি কমে আসছে। যেটুকু আছে তার সুরক্ষাও আমরা দিতে পারছি না। নানামাত্রিক অপরিকল্পনায় ভূমির অবক্ষয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে গাছপালা কমছে; বনজঙ্গলের পরিধি ছোট হচ্ছে। অপরদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রভাব পরিবেশের ওপর এসে পড়ছে।’

মাটির অবক্ষয়ে সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, ‘এতে বন্যা, খরা, উষ্ণতা বাড়ছে; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের উর্বর মাটিও লবণাক্ত হচ্ছে। প্রতি বছর নতুন নতুন এলাকা লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর মানে মাটির যে উৎপাদিকা শক্তি ছিল, তা অনেকাংশে কমে আসছে।

‘ফসলের উৎপাদন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। একই জমি থেকে বারবার খাদ্য উৎপাদনের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাচ্ছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।’

বাড়ছে লবণাক্ততা

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ২০০৯ সালের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কারণ হলো মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর আবাদযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত। এসব জমির বেশিরভাগ শুষ্ক মৌসুমে পতিত থাকে। বাকি সময়ে জমিগুলোর উৎপাদনশীলতা দেশের অন্যান্য ভূমির তুলনায় সর্বনিম্ন স্তরে।

এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. খলিলুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাটির ওপর নির্বিচার অত্যাচার হচ্ছে; ব্যবহারে চরম অব্যস্থাপনা চলছে। কংক্রিটে ঢেকে যাচ্ছে মাটি।

‘কৃষি জমিতে হচ্ছে ইটভাটা; ফাঁকা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে রাসায়নিক। এতে মাটির মাইক্রোস্কোপিক (ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র) উপাদান মইরা শেষ। সবাই মনে করে মাটি জীবনবিহীন, কিন্তু মাটি সার্বজনীন জীবন্ত। এটা তো কেউ মানেই না।’

মাটি বাঁচিয়ে স্থাপনা নির্মাণে গুরুত্বারোপ করে এ অধ্যাপক বলেন, ‘এটা ঠিক, আমাদের ঘরবাড়ি, নালা, বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা কিংবা অন্যান্য অবকাঠামো সবকিছুরই দরকার আছে, তবে এর সবকিছুই হতে হবে পরিবেশবান্ধব। যা-ই আমরা করিনা কেন, তা মাটিকে বাঁচিয়ে রেখেই করতে হবে, তবেই পরিবেশ ভালো থাকবে।

‘পরিবেশ ভালো না রাখা গেলে মাটির জীবনশক্তি কমে যাবে। এতে গাছপালা, উদ্ভিদ মরে যাবে এবং কমে যাবে। ফসলের উৎপাদনও কমে আসবে। মাটির অপরিকল্পিত ব্যবহার ও জীবনচক্র নষ্ট করে আসলে আমরা নিজেদেরই ধ্বংস ডেকে আনছি। এই প্রবণতা ভবিষ্যতের জন্য যে খুব খারাপ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিধান কুমার ভান্ডার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বে ৮৩৩ মিলিয়ন (৮৩ কোটি ৩০ লাখ) হেক্টর জমি আছে লবণাক্ত। বাংলাদেশেও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটা বড় এলাকা লবণাক্ততায় আক্রান্ত, যার পরিমাণ ১০ লাখ ৫৬ হাজার একর। এই অঞ্চলে শুধু বর্ষাকালেই ধান হয়; বাকি সময়ে আবাদশূন্য থাকে। তাই লবণাক্ত মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করাই সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ।’

তিনি বলেন, ‘এর জন্য এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা দরকার যাতে করে লবণ কম হয়। এ রকম ২২টি প্রযুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি আমরা, যার ব্যবহারে সুফল পাওয়া যাচ্ছে।

‘আগামীতে এ ধরনের নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে লবণাক্ত অঞ্চলের ফসল উৎপাদন বাড়াতে নিরন্তর কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।’

লবণাক্ততা কমানোর চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব দিয়ে ৫ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালন হচ্ছে মৃত্তিকা দিবস। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়, ‘লবণাক্ততা রোধ করি, মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করি।’

ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতে

ভারতের বিখ্যাত যোগগুরু জগদীশ বাসুদেব ওরফে সাধগুরু বলেন, ‘এই পৃথিবীর মাটির আমরা যে ক্ষতি করেছি, তা সাংঘাতিক। অন্যান্য জিনিস, যেমন: কোথাও বরফ গলছে, সেটা হয়তো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মাটির যে ক্ষতি আমরা করেছি, তা খুবই ভয়ংকর।

‘কিন্তু দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ মানুষ মাটিকে অবহেলা করেন। যখন বুঝতে শেখেন, ততক্ষণে একটু বেশিই দেরি করে ফেলেন। এটাই সর্বনাশের বড় কারণ।’

পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার উপায় বাতলে দিয়েছেন মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. খলিলুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘রাস্তাঘাট, মেগাপ্রজেক্ট কিংবা সব ধরনের শিল্প-কারখানা পরিকল্পনামাফিক করা উচিত। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের অনুমোদন ছাড়া আর কোনো প্রকল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ করা উচিত নয়। কৃষিজমি কেটে ইট ও ইটের ভাটা তৈরি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা উচিত।

‘মাটিকে জীবন্ত রাখতে হবে। মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোকে বাঁচাতে হবে। তাহলেই ভূমি উর্বর থাকবে। ফসলি জমিতে রাসায়নিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিটি শিল্পের পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম হব।’

অভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আন্তর্জাতিক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমাদের ঘরও লাগবে, গাছপালা, কৃষিজমি, বাগানও রক্ষা করতে হবে। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন ছাড়া ভবিষ্যৎ কারও জন্যই নিরাপদ হবে না।

‘নদীভাঙন ও বন্যা ঠেকানোর জন্য শক্তিশালী বাঁধ তৈরি, সার্বক্ষণিক নদীর নাব্য রক্ষা এবং খরা থেকে বাঁচতে সহজলভ্য সেচ ব্যবস্থাই কার্যকর সমাধান আনতে পারে।’

ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে তিনি আরও উন্নত প্রযুক্তির পানিশোধন প্রকল্প নেয়ার পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিধান কুমার ভান্ডার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের অন্যতম উন্নয়ন লক্ষ্যই হলো টেকসই প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার বাড়িয়ে এবং মাটির অবক্ষয় কীভাবে সর্বোত্তম উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নির্ধারণ করে কৃষিজমি সুরক্ষা দিয়ে শিল্পোৎপাদন বাড়ানো।

‘একই সঙ্গে শিল্পের পরিত্যক্ত বর্জ্যের ব্যবহারও পরিকল্পিত রাখা, যাতে করে মাটি, পানি ও পরিবেশ বিষময় না হয়। আমরা সবকিছুর মধ্যে সেই ব্যালেন্স রক্ষা করেই পরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’

এ বিভাগের আরো খবর