পুঁজিবাজার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের আগে আগে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারে নতুন করে বিনিয়োগ না করে অপেক্ষায় আছেন।
বৈঠকে ভালো কিছু হবে, এমন আশায় বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না, তবে কেনাবেচা বেশ কম। তিন কর্মদিবস পর লেনদেন আবার নেমে এসেছে হাজার কোটি টাকার নিচে।
রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ৩ মিনিটেই সূচক ৩৩ পয়েন্ট বেড়ে শুরু হয় লেনদেন। বেলা সোয়া ১১টায় সূচক বেড়ে যায় ৪৮ পয়েন্ট। তবে সেখান থেকে দুপুর ১২টা ৭ মিনিট পর সূচক টানা পড়তে থাকে।
আগের দিনের চেয়ে সূচকের অবস্থান ৫ পয়েন্ট কম ছিল সে সময়। এরপর আবার পতনের আশঙ্কা তৈরি হয়। তবে সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। আগের দিনের চেয়ে ২৯ পয়েন্ট বেড়ে শেষ পর্যন্ত সূচকের অবস্থান দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৬৫ পয়েন্টে।
এ নিয়ে টানা তিন কর্মদিবসে সূচক বাড়ল ২৬২ পয়েন্ট। তবে লেনদেনে পড়েছে ভাটা। বৃহস্পতিবার ১ হাজার ২৪৫ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা ছিল লেনদেন। সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯৪ কোটি ৯৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
দিন শেষে বেড়েছে ২৪৫টি কোম্পানির দর, কমেছে ৭৯টির। দর ধরে রাখতে পেরেছে আরও ৪৯টি।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
প্রায় সব খাতেই গেছে ভালো দিন। তবে প্রধান খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো গেছে বিমায়। বেশ কিছুদিন পরে বস্ত্র খাতে একটি ভালো দিন দেখলেন বিনিয়োগকারীরা। প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগকারীরাও হাসিমুখে শেষ করেছেন লেনদেন।
লেনদেনে সেরা ব্যাংক খাতে দেখা গেছে মিশ্র প্রবণতা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিবিধ খাতের প্রধান কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার দিনভর ওঠানামা করেছে। শেষ পর্যন্ত ২০ পয়সা কমেছে শেয়ার দর।
আড়াই মাস ধরে দর সংশোধনে থাকা পুঁজিবাজারে সম্প্রতি টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয় বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে বিরোধ ইস্যুতে।
গত ৩০ ডিসেম্বর দুই পক্ষের বৈঠকের পর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা যা এক্সপোজার লিমিট ও বন্ডে বিনিয়োগ নিয়ে মতভিন্নতার অবসানের আশা তৈরি হয়।
সেই বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেউ বক্তব্য না দিলেও বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ জানান, শেয়ারের ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার লিমিট গণনা ও বন্ডে বিনিয়োগ ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখার বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। তারা নীতিগতভাবে এসব বিষয়ে একমত হয়েছেন।
পরদিন পুঁজিবাজারে হয় উত্থান। এক দিনেই সূচক বাড়ে ১৪৩ পয়েন্ট। তবে সেদিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক বিজ্ঞপ্তিতে তৈরি হয় উদ্বেগ।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএসইসি কমিশনারের বরাত দিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সেসব সঠিক নয়।
এই খবরে বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসে লেনদেন শুরুই হয় ৮৪ পয়েন্ট পতনের মধ্য দিয়ে। তবে এ সময় তার আগের রাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশ তুমুল আলোচনা তৈরি করে, ঘুরে দাঁড়ায় বাজার। শেষ পর্যন্ত লেনদেন শেষ হয় ৮৯ পয়েন্ট সূচক বাড়ার মধ্য দিয়ে।
আগামী ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পুঁজিবাজার নিয়ে বৈঠক ডেকেছে মন্ত্রণালয়। এতে বিএসইসি চেয়ারম্যান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ডাকা হয়েছে।
ওই বিকেলে রাজধানীতে এক আলোচনায় বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারের যে আন্তরিকতা আছে, তা প্রকাশ হবে সামনের কিছু দিনে।
এসব ঘটনার পর শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিতে যায় পুঁজিবাজার। এই সময়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা আলোচনা, পর্যালোচনা, তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়। বাজার নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কী আসছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান পাল্টাবে কি না, বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হবে- এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে থাকে পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে।
দিনভর উত্থান-পতনে থাকা পুঁজিবাজার শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক অবস্থান নিয়ে লেনদেন শেষ করতে পারার পেছনে প্রধান অবদান ছিল ওয়ালটনের। ৩.৪ শতাংশ দর বাড়ায় সূচক বেড়েছে ১০.৩৩ পয়েন্ট।
সূচক বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকায় ছিল এই ১০ কোম্পানি
গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, রবি, একমি ল্যাবরেটরিজ, সিটি ব্যাংক, গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, ব্র্যাক ব্যাংক, সোনালী পেপার ও ওরিয়ন ফার্মা ছিল সূচক বাড়াতে প্রধান ভূমিকায়।
এই ১০টি কোম্পানির কারণেই সূচকে যোগ হয়েছে ২৩.২৭ পয়েন্ট।
অন্যদিকে সূচক নিচের দিকে টেনে নামানোর প্রধান চেষ্টায় ছিল ইউনাইটেড পাওয়ার, যেটির ১.০৭ শতাংশ দরপতনে সূচক পড়েছে ১.৪২ পয়েন্ট।
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি, সামিট পাওয়ার, এমজেএলবিডি, শাহজিবাজার পাওয়ার, পাওয়ারগ্রিড, বেক্সিমকো ফার্মা, বিএসআরএম লিমিটেড, বিকন ফার্মা ও রেনাটাও ছিল একই ভূমিকায়।
তবে দরপতনের হার বেশি না হওয়ায় এই ১০টি কোম্পানি সূচক নিচে নামাতে পেরেছে কমই। সব মিলিয়ে কমেছে ৭.৫৩ পয়েন্ট।
বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ার দিন সূচক টেনে ধরেছে এই ১০ কোম্পানি
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
এই তালিকায় কোনো একক খাতের প্রাধান্য দেখা যায়নি। তবে সবচেয়ে বেশি ছিল বিমা খাতের ৩টি কোম্পানি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ দাম বেড়েছে এশিয়ার ইন্স্যুরেন্সের। শেয়ারদর ৮২ টাকা থেকে ৮ টাকা ২০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৯০ টাকা ২০ পয়সা।
কোম্পানিটির ৪ রাখ ৩৩ হাজার ৫৭১ টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়।
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কাগজ ও প্রকাশনা খাতের পেপার প্রসেসিং। ওটিসি ফেরত কোম্পানিটি চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশ ভালো আয় করেছে। এই খবর প্রকাশের পর শেয়ারদর এক দিনে যত বাড়া সম্ভব, বেড়েছে ততটাই। ৯.৯৮ শতাংশ বেড়ে ১৪৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ১৫৯ টাকা ৬০ পয়সা।
তৃতীয় অবস্থানে ছিল বস্ত্র খাতের স্ট্রাইলক্রাফট। লোকসানি কোম্পানিটির শেয়ারদর সম্প্রতি অনেকটাই কমেছে। এক দিনে ৯.৯৫ শতাংশ বেড়ে ৯৭ টাকা ৪০ পয়সা থেকে হয়েছে ১০৭ টাকা ১০ পয়সা।
চতুর্থ অবস্থানে ছিল নতুন তালিকাভুক্ত সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্স। গত ৭ নভেম্বর ১০ টাকায় লেনদেন শুরুর পর প্রতিদিনই সর্বোচ্চ পরিমাণে বেড়ে শেয়ারদর এখন দাঁড়িয়েছে ৭২ টাকা।
আজ বেড়েছে ৯.৯২ শতাংশ। ৪৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকায় হাতবদল হয়েছে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৬৬৯টি শেয়ার। আগের দিন ৬৫ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছিল ৪৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯০৪টি শেয়ার।
যে ছয় খাতে লেনদেন সবচেয়ে বেশি
বিমা খাতের আরেকটি কোম্পানি প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের দরও বেড়েছে দিনের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত। ৯.৯০ শতাংশ বেড়ে ৫৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে হয়েছে ৫৯ টাকা ৯০ পয়সা।
দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায় ছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আইএসএনও। ৯.৮৮ শতাংশ বেড়ে ৩৫ টাকা ৪০ পয়সা থেকে হয়েছে ২৮ টাকা ৯০ পয়সা।
একই খাতের আমরা নেটওয়ার্কের দরও বেড়েছে দিনের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত। ৯.৮১ শতাংশ বেড়েছে কোম্পানিটির শেয়ারদর।
এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সিভিও পেট্রোকেমিক্যালের দর ৯.২১ শতাংশ, জেমিনি সি ফুডের দর ৮.৭২ শতাংশ এবং রহিমা ফুডের দর বেড়েছে ৮.৬২ শতাংশ।
শীর্ষ ১০ ছাড়া অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৮ শতাংশের বেশি ৩টির, ৭ শতাংশের বেশি ৬টির, ৬ শতাংশের বেশি ৫টির, ৫ শতাংশের বেশি ১৩টির, ৪ শতাংশের বেশি ২৫টির, ৩ শতাংশের বেশি ২৬টির, ২ শতাংশের বেশি বেড়েছে ৪৯টি কোম্পানির দর।
দরপতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ছিল মিউচ্যুয়াল ফান্ড ভ্যানগার্ড বিডি ফাইন্যান্স মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান। ফান্ডটি এবার ইউনিটপ্রতি লভ্যাংশ দিয়েছে দেড় টাকা। এরপর দুই দিনে শেয়ারদর কমল ১ টাকা ৬০ পয়সা।
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শাহজিবাজার পাওয়ার, যার দর কমেছে ৪.৩৭ শতাংশ।
তৃতীয় অবস্থানে ছিল ইমাম বাটন, যার দর কমেছে ৩.৭৫ শতাংশ; চতুর্থ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ সাবমেরিন কোম্পানি, যার দর কমেছে ৩.২৫ শতাংশ।
দরপতনের পঞ্চম স্থানে ছিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, যার দর কমেছে ৩.২৪ শতাংশ।
এছাড়া এনভয় টেক্সটাইলের দর ৩.০৪ শতাংশ, এমজেএল বিডির দর ২.৯৬ শতাংশ, নতুন তালিকাভুক্ত একমি পেস্ট্রিসাইডসের দর ২.৭১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের দর ২.৬০ শতাংশ এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দর ২.৫৯ শতাংশ কমেছে।
শীর্ষ দশের বাইরে আরও ৫টি কোম্পানির দর ২ শতাংশের বেশি এবং ২৭টির দর ১ শতাংশের বেশি কমেছে।
লেনদেনে সেরা
এই তালিকায় আবার বেক্সিমকো লিমিটেড। শেয়ারদর ২০ পয়সা হারালেও লেনদেন হয়েছে ১১৭ কোটি ৩০ লাখ ৪৯ হাজার টাকার। দিনভর শেয়ারদর ১৭১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৬৪ টাকা পর্যন্ত উঠানামা করেছে। দিন শেষে দর দাঁড়িয়েছে ১৬৮ টাকা।
বেশিরভাগ খাতেই লেনদেন কমে গেছে
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সাম্প্রতিক সময়ে তুমুল আগ্রহ তৈরি করা ওয়ান ব্যাংক। শেয়ার প্রতি ৫০ পয়সা দর হারানো কোম্পানিটিতে লেনদেন হয়েছে ৩৮ কোটি ৮৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। হাতবদল হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৮১২টি শেয়ার।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে ৩৩ কোটি ১৪ লাখ ২৪০ টাকা।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে লেনদেন হয়েছে ৩০ কোটি ১৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
পঞ্চম স্থানে ছিল পাওয়ারগ্রিডে লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি ৭২ লাখ ৩ হাজার টাকার।
শীর্ষ দশের অন্য পাঁচটি কোম্পানি হলো ফরচুন সুজ, আইএফআইসি ব্যাংক, ওরিয়ন ফার্মা, সোনালী পেপার ও একমি পেস্ট্রিসাইডস।
সব মিলিয়ে ১০টি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে ২৪৫ কোটি ২৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, যা মোট লেনদেনের ২৭.৪০ শতাংশ।