নতুন মৌসুমে আখ মাড়াই শুরু হয়েছে নাটোর চিনিকল ও নর্থবেঙ্গল চিনিকলে। কাজ শুরু হলেও নাটোরের এই দুই চিনিকল সক্ষমতার অর্ধেক সময়ও চলবে না আখ সংকটে।
তীব্র আখ সংকটের কারণে কয়েক বছর ধরেই চিনিকল দুটি গুনছে লোকসান। গত মৌসুমেও নাটোর চিনিকল গুনেছে ৩২ কোটি টাকার লোকসান। নর্থবেঙ্গলের ক্ষতি ছিল ২০ কোটি টাকা।
এমন পরিস্থিতিতে যেখানে আখ উৎপাদন বাড়ানোর কথা ছিল, সেখানে এ বছর আখ উৎপাদন হয়েছে অর্ধেকেরও কম জমিতে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে নাটোর চিনিকলে আখ দেয়া চাষিদের জমির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৫৮৪ একর। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেখানে আখ চাষ হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৫৩৫ একর জমিতে।
চিনিকলের কর্মকর্তারা বলছেন, এই জমির আখ দিয়ে চিনিকল চলবে মাত্র এক মাস, অথচ প্রায় ছয় মাস ধরে চলবে আখ মাড়াইয়ের মৌসুম।
নর্থবেঙ্গল চিনিকলের অবস্থাও একই। ২৬ হাজার ৫০ একর জমি থেকে কমে এবার আখ চাষ হয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৪ একরে।
আখ চাষিরা বলছেন, দাম কমসহ সময়মতো টাকা না পাওয়ায় আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা। আবার সরকার থেকেও তাদের প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না।
নাটোর চিনিকলে এ বছর আখ মাড়াই শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। আর ২৬ নভেম্বর মাড়াই শুরু করেছে নর্থবেঙ্গল চিনিকল।
গত দু-তিন বছর ধরেই এ দুই চিনিকল চাহিদা অনুযায়ী আখ না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে যায়। এবারও একই অবস্থা হবে।
নাটোর সদর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের আখচাষি মামুন হোসেন জানান, আগে তার বাবা-চাচারা প্রায় ৪৫ বিঘা জমিতে আখ চাষ করতেন। কম দামের পাশাপাশি সময়মতো পাওনা না পাওয়ায় তারা এখন পাঁচ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেন।
একই গ্রামের আখচাষি কামরুল ইসলাম জানান, এখন কৃষি জমিতে বছরে দু-তিন ধরনের ফসল হয়। সেই ফসল নগদে বিক্রি করা যায়। অন্যদিকে বিঘাপ্রতি আখের যা ফলন হয় তা দিয়ে লাভ হয় না।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে এক মন আখের দাম ১৪০ টাকা, যা অন্য ফসলের তুলনায় খুবই কম। এ ছাড়া জমি তৈরি, সার, বীজ, শ্রমিক খরচ সব নগদ টাকায় করতে হলেও সুগার মিলে আখ সরবরাহ করে বছরের পর বছর টাকার জন্য ধরনা দিতে হয়। তাই তারা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
চিনিকল বাঁচাতে সরকারকে উন্নতমানের বীজ, সারসহ সবকিছু কৃষকদের মাঝে সহজ শর্তে সরবরাহ করতে হবে বলেও জানান তিনি।
আখের দাম নিয়ে আখচাষি মামুন জানান, বর্তমান জাতে এক একর জমিতে এখন আখ পাওয়া যায় ৩০০ মনের মতো। ১৪০ টাকা মন হিসাবে সেখান থেকে পাওয়া যায় ৪২ হাজার টাকা। উৎপাদন খরচ লাগে ১৮-২০ হাজার টাকা। এক একর জমিতে সারা বছরে মাত্র ১৫-২০ হাজার টাকা লাভে কিছুই হয় না।
তিনি আরও জানান, উন্নতজাতের আখের পাশাপাশি ভালো মতো সার ও পরিচর্যা করলে এই আখই একরে ৭৫০ মন পাওয়া যায়। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকায় যাবে। মনপ্রতি দাম ২০০ টাকা দিলে সে ক্ষেত্রে চিনিকলের পাশাপাশি তারাও লাভবান হতেন।
তবে সরকারি সহায়তা না থাকা ও পাওনা পেতে দেরি হওয়ায় তারা এখন আখ চাষের আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছেন।
নাটোর চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মসলেম উদ্দিন বলেন, ‘চিনিশিল্পকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে এদিকে সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে। আখচাষিদের প্রণোদনার আওতায় এনে তাদের মধ্যে উন্নতমানের বীজ সরবরাহের মাধ্যমে সংকট নিরসন হবে। সেই সঙ্গে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতসহ সময়মতো কৃষকদের টাকা পরিশোধ করতে হবে।’
আখ সংকটে নির্ধারিত সময়ের আগেই মিল বন্ধ করতে বাধ্য হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নাটোর চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনোয়ার হোসেন জানান, গত বছর এ চিনিকলে লোকসান ছিল ৩২ কোটি টাকা। তবে তারা সংকট নিরসনে কৃষকদের সময়মতো পাওনা টাকা দেয়া, উন্নতমানের বীজ সরবরাহসহ চিনিকলের উন্নয়নে সব উদ্যোগ নিচ্ছে।
এরই মধ্যে শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অতিরিক্ত সচিব আরিফুল ইসলাম তপু নাটোরের দুই চিনিকল পরিদর্শন করেছেন বলে জানালেন আনোয়ার।
তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষকদের প্রণোদনাসহ উন্নতমানের বীজ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছি। চলতি বছর নাটোর চিনিকলে এক লাখ টন আখ মাড়াই করে সাত হাজার ৬০০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।’
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবীর জানান, এই চিনিকলে চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৮৬ টন আখ মাড়াই করে ১৩ হাজার ৬০০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গত বছর করোনাভাইরাসের কারণে কৃষকদের মাঝে উন্নতমানের বীজ ও সার সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এ বছর চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন চিনিকলের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ আবারও চিনিকল লাভের মুখ দেখবে বলে আশা করছি।’