দেশে চলতি বছরের নভেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭৯টি। এতে প্রাণ গেছে ৪১৩ জনের, আহত ৫৩২ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়, ৪৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে মাসভিত্তিক প্রতিবেদনে শনিবার এসব তথ্য দেয় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। তাদের তথ্যসূত্র সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, সড়ক দুর্ঘটনায় নভেম্বরে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে নারী ৬৭ জন, শিশু ৫৮ জন। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় ৯৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন।
১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন, যা মোট নিহতের ৪৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাজধানীতে নিরাপদ সড়কসহ নানা দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের প্রসঙ্গটিও টেনে আনেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা যে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করছে, এটা তো ছাত্রদের করার কথা না। এটার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের এবং সরকারের। ছাত্ররা তো বাধ্য হচ্ছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করতে। এই আন্দোলনের প্রতি আমাদের নৈতিক সমর্থন আছে এবং সবারই সমর্থন দেয়া উচিত।
‘তবে আন্দোলনের নামে অরাজকতা হোক, গাড়ি ভাঙচুর-অগ্নি সংযোগ হোক সেটা আমরা চাই না। আমরা চাই মানুষ নিরাপদে সড়কে যাতায়াত করুক। পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত উন্নতির মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করুক। পরিবহন মালিকরা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সচেতন হোক। সবশেষে মানুষ সচেতন হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নভেম্বর মাসে সাতটি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত হন, নিখোঁজ ৫ জন। আর রেলপথে ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত হয়েছেন, আহত ২ জন।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ১৮৪ জন, বাসযাত্রী ২৩ জন, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি যাত্রী ১২ জন, মাইক্রোবাস-প্রাইভেট কার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ যাত্রী ৯ জন, থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-টেম্পু-লেগুনা) ৬৬ জন।
এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) ১৭ জন এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ৬ জন নিহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৫৬টি জাতীয় মহাসড়কে, ১৩১টি আঞ্চলিক সড়কে, ৫৩টি গ্রামীণ সড়কে, ৩৫টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনাগুলোর ৮৯টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৩৩টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৯১টি পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেয়া, ৫৯টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৭টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
যানবাহন অনুযায়ী দুর্ঘটনার হার
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রাম ট্রাক ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেট কার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, মোটরসাইকেল ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, থ্রি-হুইলার ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা
সংস্থাটি বলছে, দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৪৬টি। এর মধ্যে ট্রাক ৭৮, বাস ৬৩, কাভার্ডভ্যান ১২, পিকআপ ২৭, ট্রলি ৮, লরি ৩, ট্রাক্টর ৬, মাইক্রোবাস ১৩, প্রাইভেট কার ১১, অ্যাম্বুলেন্স ৩, জিপ ২, পুলিশ পিকআপ ২, ড্রাম ট্রাক ৪, মোটরসাইকেল ১৬৭, থ্রি-হুইলার ১০৯, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ২২ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১৬টি।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৮৩টি দুর্ঘটনায় নিহত ১০৪ জন। সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে; ২২টি দুর্ঘটনায় নিহত ২৪ জন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ২১টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত। সবচেয়ে কম লালমনিরহাট জেলায়। দুটি দুর্ঘটনা ঘটলেও কেউ হতাহত হয়নি। ঢাকায় ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে বলছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশ
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্ট নির্দিষ্ট করতে হবে, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, রেল ও নৌপথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে হবে, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সর্বোপরি ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।