পুঁজিবাজার নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সভা ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রতিনিধি ছাড়াও থাকবেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থ বিভাগ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির প্রতিনিধি।
আগামী মঙ্গলবার বেলা ১১টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এই বৈঠক হবে বলে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিএসইসি ও বিআইসিএম শাখা থেকে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব নাহিদ হোসেন সাক্ষরিত এই বিজ্ঞপ্তিতে এই বৈঠকের কারণ হিসেবে ‘পুঁজিবাজার উন্নয়নের’ কথা জানানো হয়েছে।
বলা হয়েছে, অর্থমন্ত্রীর সাঙ্গে অংশীজনের মতবিনিময় সভার প্রস্তাবনাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন কাজ সমন্বয় ও তদারকির জন্য এই আলোচনা হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং পুঁজিবাজার কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকি কমিটির আহ্বায়ক মফিজ উদ্দীন আহমেদ এই সভার সভাপতিত্বে থাকবেন। সভায় গভর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যান তাদের প্রতিনিধি পাঠাবেন বলে জানা গেছে।
এই বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব মফিজ উদ্দীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আগেই নানা বিষয় আলোচনা হয়েছিল যেসব বিষয় নিয়ে, সেগুলোর বাস্তবায়ন, অগ্রগতি ও পর্যালোচনার জন্য এই বৈঠক ডাকা হয়েছে।’
তবে কোন কোন বিষয় কবে আলোচনা হয়েছিল, সেগুলো উল্লেখ করেননি এই কর্মকর্তা।
পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই বৈঠকের দিকে দৃষ্টি রয়েছে বিনিয়াগকারীদের।
আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদের প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বাজার যখন উত্থানে ছিল, তখন এই বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তবে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে বাজার সংশোধন শুরু হওয়ার পর এই মতভেদ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এর মধ্যে গত মঙ্গলবার দুই পক্ষে আনুষ্ঠানিক একটি বৈঠক হয়। এতে আলোচনা হয় মূলত চারটি বিষয় নিয়ে। তবে বিনিয়োগকারীরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন দুই ইস্যুতে। প্রথমত ব্যাংকের শেয়ার কেনার বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে নাকি বাজারমূল্যে বিবেচনা করা হবে; দ্বিতীয়ত, বন্ডের বিনিয়োগ ব্যাংকের এই বিনিয়োগসীমার বাইরে থাকবে কি না।
বন্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের বুঝিয়ে বলেছি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বন্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমার মধ্যে না রাখতে। এতে বাংলাদেশের বন্ড বাজার বড় হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।’
বৈঠকের পর দিন পুঁজিবাজারে বড় উত্থান হয়। টানা পতনের মধ্যে থাকা পুঁজিবাজারে এক দিনেই সূচক বেড়ে যায় ১৪৩ পয়েন্ট।
তবে এ নিয়ে উচ্ছ্বাসের মধ্যে সন্ধ্যার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে ফের উদ্বেগ দেখা যায়। এই বিজ্ঞপ্তির ভাষার সঙ্গে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিনের বলা কথার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তারপরেও বৈঠকের পর কোনো কথা না বলার একদিন পর এই বিজ্ঞপ্তি বিনিয়োগকারীদের মনে প্রশ্ন জন্ম দেয়।
বিএসইসি কমিশনার জানিয়েছিলেন, তারা আলোচনায় ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন, নীতিগতভাবে একমত হতে পেরেছেন। তার বক্তব্য ছিল এমন: ‘এক্সপোজার লিমিট নিয়ে আমরা নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছি। আমরা এটা রিভিউ করব। গ্লোবালি এক্সপোজার লিমিট কস্ট প্রাইজের ভিত্তিতে করা হয়। এটি টেকনিক্যাল বিষয়, আরও গভীরভাবে আলোচনা করতে হবে।
‘আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। এগুলোর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষ করে বিস্তারিত জানানো হবে।’
সেই বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলামও সাংবাদিকদের বলেন, ‘খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। যে বিষয়গুলোয় আলোচনা হয়েছে, সামনে এসব বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তির ভাষাটা ছিল এমন- ‘সভা শেষে বিএসইসি কমিশনের প্রতিনিধির বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উক্ত সভায় কতিপয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে তা সঠিক নয়।’
এতে বলা হয়, ‘সভায় পুঁজিবাজারে তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।…ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ এ পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের বিষয়ে বিদ্যমান কতিপয় আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয়েও বিএসইসি প্রতিনিধি দলকে স্পষ্টীকরণ করা হয়। তবে এসব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকের দুই দিন আগেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের বক্তব্য জানিয়ে এসেছে বিএসইসি। সরকার যেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে, সে অনুরোধ জানানো হয়েছে এতে।
আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিএসইসির বৈঠকের পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনি সরকার প্রধানকে জানান, বাজার মূল্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ হওয়ায় পুঁজিবাজারে অযাচিত বিক্রয়চাপ তৈরি হচ্ছে। এ কারণে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের অনুরোধ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন, সেটি না জানালেও বিএসইসি চেয়ারম্যান বৈঠকের ফলাফল প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুপার হয়েছে। এক্সিলেন্টও।’
যে আলোচনা হয়েছে, তা পুঁজিবাজারে কেমন প্রভাব ফেলবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনেক ভালো হবে। সব আলোচনা হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ে।’
বিএসইসির সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই বিজ্ঞপ্তির পর গণমাধ্যমের সামনে আসতে চেয়েছিলেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। পরে তিনি কথা বলেন অর্থ সচিবের সঙ্গে। সচিব তাকে কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিষয়টি তারা দেখছেন।