ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্সসহ সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রতারণামূলক লেনদেন বন্ধে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটির (ইউভিআইডি) রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় মনে করছে, এই রূপরেখা অনুযায়ী সবাইকে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটির আওতায় আনা গেলে দেশের সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধান সহজ হবে এবং ব্যবসায় শৃঙ্খলা আসবে।
এই লক্ষ্যে রূপরেখায় সেইফ গার্ড পদক্ষেপ হিসেবে প্রতারণায় জড়িত যেকোনো ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্তকরণের সহজ ৮টি উপায় চিহ্নিত করা হয়েছে। আর তা মাঠপর্যায়ে চার ধাপে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে এর আওতায় ই-কমার্স খাত বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে ইউভিআইডিতে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। যা চলতি ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
তবে ই-কমার্সসহ সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ইউভি আইডির আওতায় আনতে হলে এ সংক্রান্ত আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রয়োজনীতাও উল্লেখ করা হয়েছে ইউভিআইডির রূপরেখায়। একই সঙ্গে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটি নিবন্ধন দেয়ার দায়িত্ব যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক (আরজেএসসি) প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
মনিটরিংয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ই-কমার্স সেলকে দায়িত্ব প্রদান এবং সেই সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকেও নিয়মিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে মনিটরিং করতে পারে বলে মতামত দেয়া হয়েছে।
গত ৩০ নভেম্বর ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটি (ইউভিআইডি) সংক্রান্ত রূপরেখা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সেল।
আগামী সপ্তাহ থেকেই ইউভিআইডির এই রূপরেখা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
যা রয়েছে ইউভিআইডর রূপরেখায়
০১. দেশে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সনাক্ত ও তদারকি সহজ করতে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে একটি ডিজিটাল সিস্টেমে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটি নম্বরের আওতায় নিবন্ধন প্রদান।
০২. সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আরজেএসসির সব লাইসেন্স বা ব্যবসায় সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন এর সাথে সংযুক্ত রাখা।
০৩. ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সহজে শনাক্ত করার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেইজের সাহায্য নেয়া।
০৪. প্রতিটি অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, ফেইসবুক পেইজ, কোম্পানি প্যাড ইত্যাদিকে ইউনিক বিজনেস আইডি নম্বর প্রদর্শন।
০৫. (www.ubid.gov.bd) ও ‘আমার সরকার’ (myGov) উভয় ওয়েবসাইট থেকে সহজ এবং অনলাইন পদ্বতিতে ইউনিক বিজনেস আইডি নম্বরের নিবন্ধন দেয়ার ব্যবস্থা। অন্যান্য লাইসেন্স বা নিবন্ধন প্রদানের সময়ও স্বয়ংক্রিয় পদ্বতিতে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন সনদ প্রস্তুত হওয়া।
০৬. ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটি সনদ গ্রহণের সময় আবেদনকারি চাইলে সরাসরি ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন, বিআইএন, আরপিএ (রিটেইলারস পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট) গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা।
০৭. সব ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটি সনদ ও ব্যবসার তথ্যাদি কেন্দ্রীয় ডাটাবেইজে সংরক্ষণ।
০৮. মোবাইল সেটসহ অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস থেকে নিবন্ধন করার ব্যবস্থা রাখা।
বাস্তবায়ন পদ্ধতি
এ টু আই এর মাধ্যমে ‘আমার সরকার’ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। ইতিমধ্যে এ টু আই এর সাথে আলোচনাক্রমে ‘আমার সরকার’ পোর্টালে একটি নিবন্ধন উইন্ডো তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।
এর মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে ইউভিআইডির নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে। পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ইউভিআইডির সার্বিক নিবন্ধন হবে।
মন্ত্রিপরিষদে জমা দেয়া ইউভিআইডির রূপরেখা সম্পর্কিত প্রতিবেদন তথ্যমতে, এ টু আই ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইটের একটি ‘ডেমো ভার্সন’ তৈরি করেছে। এটির চূড়ান্ত অনুমোদন মিললে ওই ‘ডেমো-ভার্সন’ কেই পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইটে রূপান্তর করা হবে।
বাস্তবায়নের ধাপসমূহ
প্রতিবেদন তথ্যমতে, সমগ্র নিবন্ধন প্রক্রিয়াটিকে কয়েকধাপে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
এতে প্রথম ধাপে শুধু ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিবন্ধনের আওতায় আনার কথা বলা হয়। এ প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনে গৃহীত প্রক্রিয়ার সংশোধন বা সংযোজন হতে পারে। তবে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে এই প্রথম ধাপটির বাস্তবায়ন সমাপ্ত করা সম্ভব।
নিবন্ধনের দ্বিতীয় ধাপে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটির আওতায় নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে আরজেএসসিতে নিবন্ধিত সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। এটির জন্য সর্বোচ্চ ৬ মাসের বেধে দেয়ার সুপারিশ রয়েছে।
তৃতীয় ধাপে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সকল ট্রেড লাইসেন্সকে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটির আওতায় নেয়ার পরামর্শ রয়েছে। এক বছরের মধ্যে এ প্রক্রিয়াটি শেষ করতে বলা হয়েছে।
চতুর্থ ধাপে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন বিজনেস ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর, বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
এনবিআর থেকে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিটি সনদ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর গ্রহণ বাধতামূলক করার অনুরোধ এসেছে। একই সঙ্গে ভ্যাট আইনের অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে বিজনেস আইডিন্টিটি সনদ গ্রহণও বাধ্যতামূলক করার বিধান আছে।
কেন এই ইউভিআইডির উদ্যোগ
সাধারণত নতুন যে কোনো অনিবন্ধিত ব্যবসার ক্ষেত্রে তার কোন আইডেন্টি থাকে না। বিশেষ করে যারা নতুন উদ্যোক্তা (নতুন বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারি) অনলাইন এবং ই-কমার্স ব্যবসায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি কোম্পানি, এসএমই, কারিগর বা গ্রামীণ এলাকায় ছোট কারিগর।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ ধরনের ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তাদের অবদান থাকলেও অনেক সময় ব্যবসায় নিবন্ধন না থাকার কারণে বা বিজনেস প্রোফাইল না থাকার কারণে একদিকে যেমন তারা সরকার কর্তৃক প্রদেয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশ সব ধরনের ব্যবসাকে একটি সিস্টেমের মধ্যে আনার সঠিক প্ল্যাটফর্মের অভাব এবং কোনো মনিটরিংয়ের আওতায় না থাকায় কখনও কখনও তাদের দ্বারা ভোক্তা সাধারণ প্রতারিত হওয়ারও সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইউনিক বিজনেস আইডি (এইউভিআইডি) এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হবে, যা ট্রেড লাইসেন্স অর্জন এবং ব্যবসা নিবন্ধন করার প্রক্রিয়াকে সহজ করবে।’
তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সব ধরনের ব্যবসাকে একটি অনন্য ব্যবসা শনাক্তকরণ প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনা হবে। অনিবন্ধিত ব্যবসাসমূহেকে শনাক্তকরণের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হবে। যার আওতায় সব ব্যবসার একটি বিজনেস রেডি প্রোফাইল থাকবে।
এতে যেমন স্বচ্ছ বাণিজ্যিক পরিষেবা নিশ্চিত হবে। একইভাবে সব ব্যবসাকে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটর করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারের সাধারণ নীতি, কর, ভর্তুকি, আনুষ্ঠানিক ব্যবসা এবং অন্যান্য ব্যবসাকে আর্থিক সুবিধার আওতায় থাকবে।