প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমছেই। সদ্য সমাপ্ত নভেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ১৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
এই অঙ্ক গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। আর গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে কম ২৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরের চেয়ে কম এসেছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক কমেছে ২১ শতাংশ।
মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই অঙ্ক ছিল আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।
কিন্তু সেই উল্লম্ফন আর নেই। এখন ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রতি মাসেই কমছে রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার রেমিট্যান্স প্রবাহের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে ১৫৫ কোটি ৪০ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের নভেম্বরে পাঠিয়েছিলেন ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।
আগের মাস অক্টোবরে এসেছিল ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। সেই মাসেও আগের বছরের একই মাসের চেয়ে কম এসেছিল প্রবাসী আয়।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওই বছরের এপ্রিলে মাত্র ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। মে মাসে তা বেড়ে ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলারে ওঠে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময় (২০২০-এর জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যায়। ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে।
কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রথম পাঁচ (জুলাই-নভেম্বর) ৮৬০ কোটি ৯২ লাখ (৮.৬০ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ১ হাজার ৮৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।
এ হিসাবেই এই পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২১ শতাংশ।
‘বেশি রেমিট্যান্স আসার কোনো কারণ নেই’
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে এখন যেটা রেমিট্যান্স আসে, সেটাই আসলে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের প্রকৃত চিত্র। গত অর্থবছরে যা এসেছিল সেটা ছিল অস্বাভাবিক। করোনার কারণে অবৈধ চ্যানেল হুন্ডি বন্ধসহ আরও কয়েকটি কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেশি এসেছিল। এখন বেশি রেমিট্যান্স আসার কোনো কারণ নেই।’
তিনি বলেন, ‘এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, অনন্তকাল ধরে প্রবাসীরা বেশি অর্থ দেশে পাঠাবেন, এটার কোনো কারণ নেই।’
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, ‘কোভিডের কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় এতদিন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসেনি। সেটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে। সে কারণে প্রবাহ বেড়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় প্রবাসীদের খরচ বেড়েছে। ভ্রমণ-শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করছেন তারা। এ কারণেই আগের মতো পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন না।
‘আর আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। আমাদের একটা বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির বৈশ্বিক কোনো কারণ নেই, বেড়েছে দেশীয় কারণে। সেটা হলো অবৈধ চ্যানেল (হুন্ডি) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে সরকার ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এ কারণে যারা আয় পাঠিয়েছিলেন, সবই বৈধ পথে এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে করোনায় আয় আসা কিন্তু কমেছিল। কারণ, প্রবাসীদের আয় কমে গিয়েছিল।’
দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা সোয়া কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।
রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও এই প্রণোদনা সরকার অব্যাহত রেখেছে।
রিজার্ভও কমছে
রেমিট্যান্স কমায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভেও টান পড়েছে। বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।
গত ৪ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা ছিল গত সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর পর থেকে তা ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচেই অবস্থান করছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একের পর এক রেকর্ড হয়। করোনাকালে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির এই সূচক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ২৭ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫২দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি।
তবে রপ্তানি বাণিজ্যে বেশ উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১৫ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা; যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি।