‘আমাদের মুক্তি হলো ভার্চুয়াল কোর্টে। ই-জুডিশিয়ারি ও ই-ফাইলিং চালু হলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে মামলার জট থাকবে না।’
সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে বুধবার ডিজিটাল আর্কাইভিং এবং ই-ফাইলিং ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
মামলার জট কমাতে ভার্চুয়াল কোর্টের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের ৫ এপ্রিল আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম, আমরা জজ সাহেবরা ১০ লাখ টাকা প্রধানমন্ত্রীর ফান্ডে দেয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে টাকাটা দিয়ে বললাম, কোর্ট তো ফাংশন করছে না। সারা পৃথিবীতে কোর্ট চলছে। বাংলাদেশে শুধু কোর্ট চলছে না। তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘ভার্চুয়াল কোর্ট করেন।’ ভার্চুয়াল কোর্টের আইন করা যে কত কঠিন!
‘সেই আইন আমরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে করেছি। এ জন্য আমি মাননীয় আইনমন্ত্রী, বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে ধন্যবাদ দেব। আমরা সকলে বসে ভালো করে দেখেছি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে তার পরে আমরা আইনটা করেছি।’
সে সময়কার ঘটনা বর্ণনা করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “তারপরে দেখা গেল মন্ত্রিসভা বৈঠক আর হচ্ছে না। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আবার অনুরোধ করা হলো। পরে তিনি তিনজন মন্ত্রীকে দিয়ে গণভবনে মন্ত্রিসভার মিটিং করে আমাদের আইনের জন্য যে অর্ডিন্যান্স, সেটা পাস করেছেন। সুতরাং এত স্বল্পতম সময়ে এবং পরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘যেই দিন আমার কাছে আসবে সেই দিন সাথে সাথে সই করে দিব।’ সুতরাং এই স্বল্পতম সময়ে এ আইনটা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় আইনমন্ত্রীর কাছে আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব।
“কারণ বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, জেলখানা আমার পক্ষে কন্ট্রোল করা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু একটা করেন। এখন আইনজীবীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা কোর্টে যাবেন না। তারপরে ভার্চুয়াল কোর্ট হওয়ার পরে এক লাখ লোকের জামিন হয়েছে ভার্চুয়াল কোর্ট থেকে।”
তিনি বলেন, ‘প্রথম আমাদের একটা মিসটেক ছিল; ইউএনডিপির হেল্প নিয়েছি। ইউএনডিপির রিসোর্স লিমিটেড। আর সরকারের রিসোর্স হচ্ছে আনলিমিটেড। ইউএনডিপির রিসোর্স দিয়ে জাজদের অ্যাপ দিতে পারি নাই। সব কোর্ট কাজ করতে পারে নাই। লজিস্টিকের এত অভাব ছিল।
‘এমনকি নিম্ন আদালতে তারা ফ্রি অ্যাপ দিয়ে কাজ করেছে। নিম্ন আদালতের জাজদের আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিব। তারা তখন ফ্রি অ্যাপের মাধ্যমে কাজ করেছে।’
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, “তারপর আমি দেখলাম এটা তো সমাধান হতে পারে না। কারণ এই প্যানডেমিক কত দিন চলবে তার কোনো ঠিক নাই। আমি আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, ‘আপনি তো ভার্চুয়াল কোর্ট করে দিয়েছেন। এখন তো ভার্চুয়াল কোর্ট ভালোভাবে চলছে না লজিস্টিকের অভাবে।’ তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘এটা তো আমাকে প্রথমেই বলা উচিত ছিল। আপনার কত টাকার প্রয়োজন?’
“আমি বললাম আপাতত ১০ কোটি টাকা দিলে অ্যাপ-ট্যাপ এগুলা কিনব। তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি কেউ ১০ কোটি টাকা চায়?’ আমি একটু লজ্জা পেলাম। তারপরে প্রধানমন্ত্রী মাননীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রীকে বললেন, ‘প্রধান বিচারপতি যা কিছু চাবে, সব তাৎক্ষণিক দিতে হবে।’ এরপর সাথে সাথে প্রতিমন্ত্রী সব দিয়েছেন। এরপর আমি সবকিছু চালু করতে পেরেছি। সুতরাং এটা আমার কাছে বেশি সাফল্য।”
তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে আরও বলেছিলাম, লাখ লাখ ফাইল আমাদের বারান্দায় পড়ে আছে। আমি একদিন আমাদের বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল, তখন তিনি বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাকে নিয়ে দেখলাম লাখ লাখ ফাইল বারান্দায় পড়ে আছে। তারপর গেলাম ক্রিমিনাল সেকশনে। সেখানেও একই অবস্থা। এখান থেকে ফাইল খুঁজে বের করে কোর্টে দেয়াটা দুঃসাধ্য কাজ।
‘আমরা যদি এটা আর্কাইভ করে রাখতে পারি, এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। আমি আশা করি আমরা অচিরেই এটা করতে পারব। মাননীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর প্রতি আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। তার সঙ্গে আমি দুইটি মিটিং করেছি। তিনি আমাদের ফুল সাপোর্ট দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, টাকা কোনো সমস্যা না। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে শুধু সুপ্রিম কোর্টের কাজ করার জন্য ২২০ কোটি টাকা দিয়েছে। যেখানে আমরা ভার্চুয়াল কোর্ট শুরু করেছি ১ লাখ ডলার দিয়ে, সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছে ২২০ কোটি টাকা। এখানে হচ্ছে একটা ডেটা সেন্টার, যেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে আমাদের সমস্ত কিছু থাকবে, এটার জন্য খরচ হবে ১৫০ কোটি টাকা।’
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘মাননীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী ও আইসিটি উপদেষ্টা আমাদের যেইভাবে সাপোর্ট করেছেন, আমার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। একজন প্রধান বিচারপতির সময় কোর্ট বন্ধ থাকা, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আমার জীবনে বোধ হয় কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুতরাং আমি যে কোর্ট চালু রাখতে পেরেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় আইনমন্ত্রী, আইসিটি উপদেষ্টা, আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।
‘আমি আর একটা কথা বলব, আমার উত্তরসূরি যে আসবেন, উনি এ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এটাকে অনেক সামনে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের মুক্তি হলো ভার্চুয়াল কোর্টে। কারণ আমাদের বিচারক সংখ্যা দুই, তিন গুণ করা প্রয়োজন হবে। এখনও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিল্ডিং হয়নি সব জায়গায়।’
তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে জুডিশিয়ারি পৃথক হয়েছে। এখনও সব জায়গায় ভবন হয়নি। আমরা বিচারক দুই-তিন গুণ করব। তাদেরকে কোথায় বসাব? একমাত্র ভার্চুয়াল কোর্ট যদি প্রবর্তন করা যায় তাহলে বিচারকের বাসায় থেকে, আইনজীবীদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তাহলে অচিরেই আমরা মামলার জট থেকে মুক্তি পেতে পারব। তা ছাড়া মামলার জট থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন ব্যাপার। যেমন: অ্যাফিডেভিট সেকশনে আসতে হয়, চেষ্টা করা হবে আইনজীবীর চেম্বারে আইনজীবী এনআইডির সঙ্গে করেসপন্ড করে যদি করা যায়, তাহলে অ্যাফিডেভিট সেকশনে আসতে হবে না। এর ফলে ২৪ ঘণ্টা ফাইল করা যাবে।
‘ভারতে ২৪ ঘণ্টা ফাইল করা যাচ্ছে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে আমার যে উত্তরসূরি আসবে তিনি যদি এটা করেন, বিচার বিভাগে একটা বিপ্লব ঘটে যাবে। শুধু তাই নয়, এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে জায়গায় যাচ্ছে, শুধু মুখে কথা বলবেন, লেখা হয়ে যাবে; কষ্ট অনেক কমে যাবে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন জায়গায় যাবে যে জুডিশিয়ারিতে কোনো পেন্ডিং মামলা থাকবে না।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, আইন সচিব গোলাম সারোয়ার। এ সময় আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন।