ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে বিবেচনা, পাশাপাশি বন্ডে বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানানোর পর পড়তে থাকা শেয়ারমূল্য দিয়েছে লাফ। এক দিনে ৩০০ কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ার প্রভাবে সূচক বেড়েছে ১০০ পয়েন্টের বেশি।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতভিন্নতার ইস্যুতে টানা দরপতনের কারণে যে হতাশা দেখা গিয়েছিল পুঁজিবাজারে, দুই পক্ষের বৈঠকের পর তার আপাত অবসান দেখা গেছে।
মঙ্গলবার বহুল প্রতীক্ষিত এই বৈঠক শেষে কোনো সার্কুলার জারি হয়নি। তবে বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে যেসব বিষয় তোলা হয়েছিল, তার প্রতিটির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।
ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্যে বিবেচনা, বন্ডে বিনিয়োগ- পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখার বিষয়ে রাজি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে এ বিষয়ে আদেশ জারি করা হবে।
সেই বৈঠকের পরদিন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাওয়ার কথা সেই রাতেই চাওর হয়ে যায়। বৈঠক শেষে বিএসইসি চেয়ারম্যান কোনো সিদ্ধান্ত না জানালেও বলেছেন, যে কথাবার্তা হয়েছে, তা পুঁজিবাজারের জন্য দারুণ হবে।
এসব ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মনের চাপ দূর হওয়ার পর বুধবার সকালে লেনদেন শুরুই হয় ১২৮ পয়েন্ট দিয়ে। লেনদেনের সাড়ে ৪ ঘণ্টায় একটিবারের জন্যও তা সেখান থেকে খুব বেশি কমে দেখা যায়নি। বরং শেষ বেলায় আরও বাড়ে।
বুধবার পুঁজিবাজারে লেনদেন পয়েন্ট বেড়েছে।
বেলা ১১টা ২৮ মিনিটে সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৫৪ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হতে থাকে। তখন সূচক ছিল ৬ হাজার ৮৫৭ পয়েন্ট। এরপর সেখান থেকে অল্প কিছু কমলেও শেষ সময়ে আবার শেয়ারদর বেড়ে সূচকের অবস্থান দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৪৭ পয়েন্ট, যা দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান।
এক দিনেই সূচক বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট।
তবে সূচকের ঊর্ধ্বগতিতেও লেনদেন সেভাবে গতি পায়নি। বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ এখনও বাজারকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। আবার যারা বেশি দামে শেয়ার কিনে ধরে রেখেছেন, তাদের কেনা দামের কাছাকাছিও আসেনি শেয়ার। এ কারণে বিক্রয় চাপ কম ছিল। এ কারণে লেনদেন আগের দিনের তুলনায় কিছুটা কম হয়েছে।
দিন শেষে বেড়েছে ২৯৩টি শেয়ারের দর, কমেছে ৪৫টির, অপরিবর্তিত ছিল ৩৫টির দর।
সূচক বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকায় ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড। টানা পাঁচ কর্মদিবস দর হারানো কোম্পানিটির শেয়ারদর এক দিনেই বাড়ল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এর প্রভাবে সূচকে যোগ হয়েছে ২১ দশমিক ৮২ পয়েন্ট।
গ্রামীণফোন, বেক্সিমকো ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা, ওয়ালটন, রবি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, ইউনাইটেড পাওয়ার, পাওয়ারগ্রিড, ডেল্টা লাইফের দর বৃদ্ধিতে সূচকে যোগ হয়েছে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানিই সূচক বাড়িয়েছে ৮৬ দশমিক ৪১ পয়েন্ট।
পুঁজিবাজারে সূচক সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে যে ১০টি কোম্পানি
অন্যদিকে পুঁজিবাজারে দারুণ দিনে এতদিন ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকা ওয়ান ব্যাংক দর হারানোয় সূচক থেকে কমেছে ১ দশমিক ০৯ পয়েন্ট।
ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউনিট হোটেল, সামিট পাওয়ার, আরামিট সিমেন্ট, তুংহাই নিটিং, ইস্টার্ন ক্যাবলস, নিউলাইন ক্লথিং, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স ও এমারেল্ড অয়েলের দরপতনের কারণে সূচক থেকে কিছু পয়েন্ট কমেছে।
তবে দরপতনের হার খুব একটা বেশি না হওয়ায় এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে কেবল ৩ দশমিক ১৩ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধিতে ১০ কোম্পানি
গত ২৮ নভেম্বর থেকে দর কমতে থাকা বিবিধ খাতের ইনডেক্স এগ্রোর শেয়ার দরে চমক লেগেছে। কোম্পানিটির দর বেড়েছে দিনের সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
তবে এই দর বৃদ্ধি নতুন বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দিলেও রেকর্ড ডেট ২৮ নভেম্বর যারা শেয়ার কিনে ধরে রেখেছিলেন তাদের জন্য খুব একটা ভালো সংবাদ দেয়নি। কারণ সেদিনও কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দর ছিল ১২২ টাকা। বুধবারও লেনদেন শেষে শেয়ার দর দাঁড়িয়েছে ১২২ টাকায়। এই সময়ে কোম্পানিটির সর্বনিম্ম দর ছিল ১১০ টাকা।
দর বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা নতুন তালিকাভুক্ত সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। দিন শেষে দর দাঁড়িয়েছে ৫৯ টাকা ৬০ পয়সা। তবে এই দামেও শেয়ার বিক্রি করতে রাজি নন বিনিয়োগকারীরা। দিন শেষে হাতবদল হয়েছে কেবল ৮৪ হাজার ৯৫৩টি শেয়ার।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৭৫ লাখ ২৩৪টি। শেয়ার দর ১৫২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬৬ টাকা ৯০ পয়সা।
বেক্সিমকোর শেয়ার দর গত ১৭ নভেম্বর থেকে টানা পতনে ছিল। ১৭২ টাকা থেকে এই সময়ে দর নেমে আসে ১৫২ টাকায়। সেখান থেকে বুধবারই প্রথম বড় উত্থান হলো কোম্পানিটির।
যেসব কোম্পানির দর বেড়েছে, কমেছে
বস্ত্র খাতের এনভয় টেক্সটাইলের দরও বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগের দিন দাম ছিল ৪৫ টাকা। দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ৪৯ টাকা ৪০ পয়সায়।
ব্যাংক খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ দর বৃদ্ধির মাধ্যমে পৌঁছেছে ১৫ টাকা ৩০ পয়সায়। ১৮ নভেম্বরের এটির ব্যাংকটির সর্বোচ্চ দর।
বুধবার ৮ শতাংশের বেশি শেয়ার দর বেড়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা ছিল তিনটি। এর মধ্যে পাট খাতের কোম্পানি জুট স্পিনার্সের দর ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ, খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতের শ্যামপুর সুগারের দর ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ আর বিমা খাতের ডেল্টা লাইফের শেয়ার দর বেড়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশের নয় ও দশ নম্বরে ছিল জিবিবি পাওয়ার, যার শেয়ার বেড়েছে ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ আর সোনালী পেপারের শেয়ার দর বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
এই ১০টি ছাড়া ৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে আরও ৭টি কোম্পানির দর। ৬ শতাংশের বেশি আরও ৩টির, ৫ শতাংশের বেশি ৭টির, ৪ শতাংশের বেশি ৬টির, ৩ শতাংশের বেশি ২৩টির, ২ শতাংশের বেশি বেড়েছে আরও ৬০টি কোম্পানির দর।
দর পতনের ১০ কোম্পানি
গত ৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে লোকসান থাকায় কোনো বছরের জন্যই লভ্যাংশ ঘোষণা না করা তুংহাই নিটিংয়ের রেকর্ড ডেটের পর প্রথম লেনদেন ছিল বুধবার। ফলে এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দরে উত্থান পতনে কোনো সীমা ছিল না। লভ্যাংশ না দেয়ায় কোম্পানিটির শেয়ার দর স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি দর পতন হয়েছে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। শেয়ার দর ৬ টাকা ৮০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৬ টাকা।
এরপরই ছিল আরামিট সিমেন্ট। কোম্পানিটির দর কমেছে ৮. দশমিক ৩০ শতাংশ। ২ কোটি ২৭ লাখ টাকা লেনদেন হওয়া কোম্পানিটির ৭৪ লাখ ৩১ হাজার ২৯টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
বুধবারের লেনদেনে যেসব কোম্পানির দাম বেড়েছে-কমেছে।
ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার দর এদিন কমেছে ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত ১৭ নভেম্বর থেকে শেয়ার দরে উত্থানে থাকা এই ব্যাংকটির য়েশার দর ৩০ নভেম্বর থেকে কমছে। বুধবার লেনদেন শেষে ব্যাংকটির দর ছিল ১৯ টাকা ৪০ পয়সা।
এদিন দর পতনের থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বস্ত্র খাতের কোম্পানি ছিল সবচেয়ে বেশি। শীর্ষ দশ কোম্পানির মধ্যে ছয়টি ছিল বস্ত্র খাতের।
মিথুন নিটিংয়ের দর কমেছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। শেয়ার দর ১২ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১১ টাকা ৬০ পয়সা। ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা লেনদেন হওয়া কোম্পানিটির মোট ১৬ হাজার ৫৫৫টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
এমারেল্ড অয়েলের শেয়ার দর কমেছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। এ ছাড়া আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের দর কমেছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
সাভার রিফ্যাক্টরিজ, নিউ লাইন ক্লথিং, সোনারবাংলা টেক্সটাইল, ইস্টার্ন ক্যাবলস, মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স ছিল দর পতন হওয়া শীর্ষ কোম্পানির তালিকায়।
লেনদেনে এগিয়ে ১০ কোম্পানি
বুধবার লেনদেনে এগিয়ে থাকা দশ কোম্পানির মধ্যে শীর্ষে বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটির মোট ১২২ কোটি ২৮ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। হাতবদল হয়েছে ৭৫ লাখ ২৩৪টি শেয়ার।
লেনদেনের শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে। এ তালিকায় দর পতন হওয়া কোম্পানি দুটি ছিল ওয়ান ব্যাংক ও একমি পেস্ট্রিসাইডস। নতুন তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এই প্রথম দাম কমল শেয়ারটির।
এদিন ওয়ান ব্যাংকের মোট লেনদেন হয়েছে ১৩২ কোট ১১ লাখ টাকা। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯১২টি।
ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের মোট লেনদেন হয়েছে ৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। হাতবদল হয়েছে ৫ কোটি ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৯৪৬টি।
ডেল্টা লাইফের লেনদেন হয়েছে ৪৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ২২ লাখ ৫ হাজার ১৯টি।
আইএফআইসি ব্যাংকের লেনদেন হয়েছে ২৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৪৪টি। এর আগে ছিল একমি পেস্টিসাইডস। যার শেয়ার হাতবদল হয়েছ ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৭২টি। লেনদেন হয়েছে ৩১ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
জেনেক্স ইফফোসিসের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
শীর্ষ দশের এই তালিকায় আরও ছিল ওরিয়ান ফার্মা, প্যারামাউন্ড টেক্সটাইল, ফরচুন সুজ।