বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে রাজধানীর নয়াপল্টনের পাশাপাশি বিভাগীয় শহরগুলোতে হয়েছে সমাবেশ। বিভিন্ন জেলার নেতা-কর্মীরা নিজ নিজ বিভাগীয় শহরে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। পুলিশের কড়া নজরদারি ছিল সমাবেশ ঘিরে।
সিলেট নগরীর রেজিস্টারি মাঠে মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়। তাতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
সমাবেশ শুরুর পর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা বিভাগে বিভাগে সমাবেশ না ডেকে ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকেন। আমরা ঢাকা অচল করে দেব। ৯ মাস লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছি। মাসখানেক লড়াই করতে পারলেই এই সরকারের পতন ঘটাতে পারব।’
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আইনি বাধা নয়, খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসায় সবচেয়ে বড় বাধা শেখ হাসিনা। তাকে সরাতে হবে। না হলে দেশ ও খালেদা জিয়াকে বাঁচানো যাবে না।’
সমাবেশে জাতীয় কমিটির সদস্য এম নাসের রহমান বলেন, ‘লিভার সিরোসিস সাধারণত পুরুষ মানুষের হয়। বেশি মদ খেলে লিভার সিরোসিস হয়, কিন্তু খালেদা জিয়া তো দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। তবে কি সরকার তার খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে? বিদেশে চিকিৎসায় গেলে এসব ধরা পড়ে যেতে পারে, তাই সরকার তাকে বিদেশ যেতে দিচ্ছে না।’
সমাবেশে দেখা উপস্থিত আছেন ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জীবন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরসহ দলের কেন্দ্রীয় ও সিলেট জেলাসহ বিভাগের অন্য জেলার নেতারা। এর সভাপতিত্ব করেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী।
প্রায় একই সময় রাজশাহী মহানগরে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে শুরু হয় সমাবেশ। তাতে যোগ দিতে আশপাশের জেলার নেতা-কর্মীরা দুপুর থেকে সেখানে জড়ো হন।
সমাবেশে প্রধান অতিথি ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আজকে যদি খালেদা জিয়ার কোনো অঘটন ঘটে, তবে দেশে যে পরিস্থিত ঘটবে, সেই পরিস্থিতি আমরা দমাতে পারব না। দেশ একটা অরাজক পরিস্থিতির দিকে চলে যাবে। সে জন্য দেশের শান্তির জন্য জনগণের শান্তির জন্য অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তি দেন, সেই ব্যবস্থা করবেন।
‘আজকে এই সরকারকে বলতে চাই, এই সরকারে পতনের আন্দোলন এখনও আমরা ঘোষণা করি নাই। এই পতনের আন্দোলনের ঘোষণা আমার করতে চাই... এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যেভাবে মাথা উঁচু করে এগিয়েছি, সেই ধরনের একটি আন্দোলনে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা করব যদি আল্লাহ চায়।’
সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু।
চট্টগ্রাম নগরীর কালামিয়া বাজার এলাকার কেবি কনভেনশন হলে দুপুরে সমাবেশ শুরুর পরপরই ভেঙে পড়ে মঞ্চ। সে সময় মঞ্চে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম) মাহবুবের রহমান শামীম, মহানগরের আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন, সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্করসহ অন্য নেতারা।
তবে সঙ্গে সঙ্গে নেমে যাওয়ায় কেউ আহত হননি। মঞ্চ ঠিকঠাক করে মিনিট দশেক পর আবার সমাবেশ শুরু হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমাবেশে বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া কোনো দোষ করেননি, তিনি দোষী নন। তাকে গায়ের জোরে সরকারের নির্দেশে একটি ভুয়া মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে।’
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা-১ পাঠ করে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের মন্ত্রীরা এই আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। এই আইনে নির্বাহী আদেশে শর্ত দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে সাময়িকভাবে সাজা মওকুফ করেছেন। এই আইনের প্রথমেই আছে বিনা শর্তে সাজা মওকুফ করা যাবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যেখানে উইদআউট কন্ডিশন আছে, সেখানে কন্ডিশন দিয়ে দিয়েছেন।
‘আজকে বলছেন আর কিছু করার নাই, আমরা বলতে চাই এই ৪০১-এর যেটা বিনা শর্তের কথা আছে, সেটা আপনি প্রয়োগ করেন। এই আদেশকে যদি সংশোধন করে বিনা শর্ত সংশোধন করা হয়, তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশ যেতে কোনো বাধা নেই। তাই আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, আইনের কোনো বাধা নেই, বাধা হচ্ছে সরকারের।’
সমাবেশে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেনের সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্করের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মো. নাছির উদ্দীন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খন্দকার, এস. এম ফজলুল হক, কেন্দ্রীয় বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীমসহ অনেকে।
খুলনা নগরীর কেডি ঘোষ রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘সমাবেশ সফল হলেও এখনও দাবি আদায় হয়নি। দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামতে হবে। ঢাকার আনাচকানাচের মানুষ আজ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। খালেদা জিয়া একা কোনো ব্যক্তি নয়, তিনি একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।’
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক আজব দেশে বসবাস করি, যেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়... ক্ষমতা থেকে নেমে গেলে কেউ থাকবে না, সবাই পালিয়ে যাবে। খালেদা জিয়ার বিষয়ে দুঃসংবাদ এলে কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। না হলে জনগণ আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।’
খুলনার এই সমাবেশে ছিলেন মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমানসহ বিভিন্ন জেলার নেতা-কর্মীরা।
এর আগে কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল নিয়ে বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সমাবেশে আসেন।
রংপুরে নগরীর দলীয় কার্যালয়ের সামনে সেখানকার সমাবেশ শুরু হয় বিকেলে। দুপুর থেকে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। বিভিন্ন স্লোগান ও কাফনের কাপড় পরে সমাবেশে যোগ দেন অনেকে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সেখানে সরকারে উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা নেমেছি। রাজপথে নেমেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মা, গণতন্ত্রের মা, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মানুষ বেগম জিয়ার সুচিকিৎসা করা হবে না, ততক্ষণ আমরা আর ঘরে ফিরে যেতে চাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজকে বাংলাদেশে জিয়ার সৈনিকরা, খালেদা জিয়ার সৈনিকরা রাজপথে নেমেছে। আমাদের প্রোগ্রাম ৫ তারিখ পর্যন্ত আছে, আমরা আর ঘরে ফিরে যাব না।’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি যুবক ভাইদের বলছি, পাকিস্তান গুলি করে যা করতে পারে নাই, এবার কাফনের কাপড় পরে বাংলাদেশের পুলিশের গুলি খাওয়ার জন্য পিঠ পেতে থাকতে হবে। তোমরা প্রস্তুত হও...।’
নেত্রীর মুক্তির দাবি নিয়ে ময়মনসিংহ নগরীর নতুন বাজারস্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে সমাবেশ করে বিএনপি।
বেলা আড়াইটার দিকে গঙ্গাদাস গুহ রোডে কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে এ সমাবেশ শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন স্থানীয় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের বিপুল নেতা-কর্মী।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রধান অতিথি হিসেবে সমাবেশে ছিলেন। এর সভাপতিত্ব করছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ কে এম শফিকুল ইসলাম।
সমাবেশে যোগ দেন বিশেষ অতিথি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শরীফুল আলম ও ওয়ারেস আলী মামুন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহীর আহসান হাবীব অপু, সিলেটের দেবাশীষ দেবু, চট্টগ্রামের আরাফাত বিন হাসান, রংপুরের রফিকুল ইসলাম, ময়মনসিংহের কামরুজ্জামান মিন্টু।