বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও চড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ। চলতি অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এর অর্থ হলো, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২১ সালের অক্টোবরে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৫ টাকা ৭০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
আগের মাস সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আগস্টে হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জুলাইয়ে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর পর থেকেই বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।
অক্টোবরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় খাতেই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে, বিবিএস মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তথ্য নতুন ভিত্তি বছরের (২০১৫-১৬) হিসাব কষে প্রকাশ করলেও মূল্যস্ফীতির তথ্য ১৫ বছর আগের ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে প্রকাশ করেছে।
এ প্রসঙ্গে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন ভিত্তি বছরের হিসাবে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের কাজ চলছে। খুব শিগগিরই তা প্রকাশ করা হবে।’
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এই লক্ষ্য ধরা ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষ হয় ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে।
অর্থাৎ বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে খানিকটা বেশি ছিল গড় মূল্যস্ফীতি।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছিল। তার প্রভাব পড়েছে ছোট-বড় সব দেশে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছিল, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছিল, খাদ্যশস্য ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যের মূল্য এখন ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক দাঁড়িয়েছে ১৩০ শতাংশ। অথচ গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
খাদ্যে ব্যয় বৃদ্ধি অবস্থাপন্ন মানুষের জন্য বড় সমস্যা না হলেও দরিদ্র মানুষের জন্য তা বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কারণ, আনুপাতিক হারে দরিদ্র মানুষের খাদ্যব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি।
সংস্থাটি বলেছিল, সারা বিশ্বেই পণ্যের মূল্য বাড়ছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে। আবার এ সমস্যার শিগগিরই সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে কানাডায়। সেপ্টেম্বরে ভোক্তা মূল্যসূচক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আগস্টের তুলনায় বেড়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০৩ সালের পর এই প্রথম এতটা মূল্যস্ফীতি বাড়ে কানাডায়। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, পরিবহন, আবাসন ও খাদ্যের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বৈশ্বিক সরবরাহ ঘাটতির প্রভাব পড়েছে দেশটির ওপরে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার খবর আগেই প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
২০২১ সালে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, তুরস্ক, ব্রাজিল, রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার ছাড়িয়েছে ৬ শতাংশের ওপরে। কারও কারও ছাড়িয়েছে দুই অঙ্ক। ট্রেডিং ইকোনমিকসের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশে, মেক্সিকো ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, রাশিয়া ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, ব্রাজিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, তুরস্ক ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও আর্জেন্টিনা ৫২ দশমিক ২ শতাংশ।
গত ১২ অক্টোবর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।
আইএমএফ বলছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এবার তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
তবে, পরিস্থিতি এখন অনেকটা পাল্টেছে। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অতিসংক্রামক ওমিক্রনের ধাক্কায় ফের ফের বেসামাল বিশ্ব অর্থনীতি। ধস নেমেছে বিশ্বের বড় বড় পুঁজিবাজারে। জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৬৮ ডলারে নেমে এসেছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও।
এ অবস্থায় বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিতে ওমিক্রনের প্রভাব কতোটা পড়বে, তার জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অবস্থা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি বড় ধাক্কা আসছে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। ওমিক্রনের ছোবলে যদি জ্বালানি তেলের সঙ্গে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমে যায়, তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখি হবে।
‘তবে, আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করে, তার সঙ্গে বাজারের পণ্য মূল্যের বাস্তব প্রতিফলনের যথেষ্ঠ ঘাটতি থাকে বলে অনেকেই প্রশ্ন করেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য বিবিএসের বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রকাশের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মাঠ পর্যায় থেকে যে তথ্য পাই, সেই তথ্যের ভিত্তিতেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা হয়। এখানে কোনো প্রশ্ন ওঠার কারণ নেই।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
আগের মাস সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ২১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ।
অক্টোবর মাসে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অক্টোবরে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এই মাসে শহর এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যালোচনায় পরিসংখ্যান ব্যুরো বলেছে, সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে চাল, আটা-ময়দা, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, সবজিসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দামই বেড়েছে।