গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে জরুরি বিভাগ থাকলেও সেখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
রোগীদের জরুরি চিকিৎসা না দিয়েই পাঠানো হয় বিভিন্ন ওয়ার্ডে। এতে তাৎক্ষণিক সেবা না পেয়ে রোগীর জটিলতা বাড়ে এমনকি অনেকের মৃত্যুও হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীর নাম-ঠিকানা রেজিস্ট্রার আর কোন ওয়ার্ডে যাবে সেটি ঠিক করে দেয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই। জরুরি বিভাগে সার্বক্ষণিক একজন চিকিৎসক থাকলেও সেখানে রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
রাজশাহী নগরীর ছোট বনগ্রাম এলাকার জাহিদুজ্জামান চলতি মাসের শুরুর দিকে তার স্ট্রোক করা মাকে নিয়ে রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান। সেখানে টিকিট কেটে খাতায় নাম এন্ট্রি করে প্রায় ২০ মিনিট পর মাকে নিয়ে পৌঁছান ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে।
এরপর রিপোর্ট নিয়ে যান ওয়ার্ড চিকিৎসকের কাছে। সেখানেও লম্বা লাইন। মিনিট বিশেক পর সিরিয়াল পান ডাক্তারের। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাইরে থেকে ওষুধপত্র আনাসহ নানা প্রক্রিয়া শেষে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর তার মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়। অথচ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সেবা মিললে চিকিৎসা আরও আগে শুরু করা যেত।
শুধু জাহিদুজ্জামানের মা নন, এভাবে প্রত্যেক রোগীকেই হাসপাতালে যাওয়ার পর এক থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে হয় চিকিৎসা শুরু হতে।
দুর্গাপুর উপজেলার সায়বাড় গ্রামের বাসিন্দা জনাব আলীর স্বজনরা জানান, জনাব আলী ডায়াবেটিস রোগী। রক্তচাপ কমে যাওয়ায় ২২ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাকে রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়।
জরুরি বিভাগে নাম, ঠিকানা এন্ট্রি শেষে তাকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে নিতে বলা হয়। রোগীকে ট্রলিতে তুলে ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলেন স্বজনরা। মাঝপথে রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাই আবারও জরুরি বিভাগের দিকে ট্রলি ঘুরিয়ে নেয়া হয়। তবে জরুরি বিভাগে পৌঁছানোর সময়ই তিনি মারা যান।
এমনকি জরুরি বিভাগে ইসিজি করার ব্যবস্থা না থাকায় তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করতে পারেনি নার্স। ইসিজি করতে পাঠানো হয় ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে। পরে জনাব আলীকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয় বেলা ১১টা ৫ মিনিটে।
একইভাবে ১৫ জুন নাটোরের সিংড়ার বাসিন্দা বেলালুজ্জামানকে নেয়া হয় রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় ৩৬ মিনিটে। এরপর চিকিৎসা শুরু হতে না হতেই তিনি মারা যান।
এভাবে অনেক রোগীই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যাচ্ছেন। জরুরি সেবা না থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
তবে জরুরি সেবার বিষয়ে রামেক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ডা. শামসুর রহমান জানান, জরুরি বিভাগে রোগী এলে তার অবস্থা বুঝেই তাকে ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। এখানে সার্বক্ষণিক একজন চিকিৎসক থাকেন। তারা রোগী দেখে প্রয়োজনে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীদের ওয়ার্ডে পাঠান।
এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগীদের জরুরি সেবা দিতে না পারার বিষয়টি নিয়ে তারা ভাবছেন। জরুরি বিভাগকে আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। এটির বাস্তবায়ন হলে এ বিভাগেই মিলবে সব ধরনের চিকিৎসা।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, বর্তমানে জরুরি বিভাগ থেকে রোগীদের তাড়াতাড়িই পাঠানো হচ্ছে। তবে রোগীদের ওয়ার্ডে যেতে যেতে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মতো সময় লেগে যায়। এই সময়টা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘১০ মিনিটের মধ্যে রোগী ম্যানেজ করতে পারলে এক ধরনের রেজাল্ট আসে, আবার ১০ মিনিট পর ম্যানেজ করলে আরেক ধরনের রেজাল্ট পাওয়া যায়। এখানকার প্রতিটি মিনিটই গোল্ডেন মিনিট।
‘এখন জরুরি বিভাগ ৮ থেকে ৯ জন ডাক্তার দিয়ে চলে। তারা সময় ভাগ করে দায়িত্ব পালন করেন। জরুরি বিভাগকে যুগোপযোগী করতে আমরা বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছি। এটি আধুনিকায়নের জন্য বাজেটও চেয়েছি। পেলে এ বিভাগ আরও সমৃদ্ধ হবে।’
পরিচালক বলেন, ‘আমাদের জরুরি বিভাগের ভবনে বর্তমানে ওয়ানস্টপ সেবা, পুলিশ বক্স, ডিএনএসহ নানা বিভাগ ঢুকে পড়েছে। এগুলো এখান থেকে সরিয়ে ভবনটি জরুরি সেবার জন্য ছেড়ে দিতে হবে। তবে ওই বিভাগগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওই বিভাগগুলোর জন্য আমরা জায়গা দিয়েছি। এখন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বাজেট এলেই কাজ শুরু করা হবে।’
জরুরি বিভাগে কী কী থাকছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে শুরু করে সব কিছুই থাকবে সেখানে। ছোটোখাটো অপারেশনও করা হবে। এখন যেমন হার্টের রোগী এলে তাকে ওয়ার্ডে পাঠাতে হয়। তখন আর সময় নষ্ট হবে না। এখানেই চিকিৎসা শুরু করব। অর্থপেডিকের চিকিৎসাও শুরু করার পরিকল্পনা আছে। অনেক রোগীকে এখান থেকেই চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে।