বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী হয়েও প্রেম আর যৌনতা নিয়ে জাকুশো সেতাওশি ছিলেন বেশ খোলামেলা। জীবদ্দশায় তিনি প্রায় চার শ উপন্যাস লিখেছেন। বলা হয়, প্রেম আর যৌনতায় ভরপুর এসব উপন্যাসের বেশিরভাগই ছিল তার নিজ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। এ ছাড়া তার অনুবাদ করা একাদশ শতকের একটি জাপানি রোমান্টিক ক্ল্যাসিক কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে।
ব্যক্তিগত সহকারীর বরাত দিয়ে শনিবার নিউ ইয়র্ক টাইমস আলোচিত এই লেখিকার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করেছে। চলতি মাসেই জাপানের কিটো শহরে ৯৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন সেতাওশি।
যৌনতা নিয়ে বিতর্কিত বিভিন্ন লেখার জন্য সেতাওশির সমালোচকেরও অভাব ছিল না। সমালোচকরা তাকে ‘গদবাঁধা লেখিকা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমালোচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- এক সন্তানসহ প্রথম স্বামীকে ত্যাগ করে নিজের চেয়ে কম বয়সী আরেকজনের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী হয়েও তিনি মদ্যপান এবং মাংস খেতেন। আর প্রত্যেক মানুষ, বিশেষ করে নারীদের যৌন স্বাধীনতা থাকা উচিত বলে তিনি প্রকাশ্যেই মত দিতেন।
যৌনতা বিষয়ে ১৯৯৯ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি এক্ষেত্রে স্বাধীন থাকাই ভালো। ইচ্ছা হলে, যে কোনো মানুষের সঙ্গেই সঙ্গম করা যেতে পারে।’
বয়স নব্বই হওয়ার পরও তিনি লেখালেখি চালু রেখেছিলেন। আর ওই বয়সে তিনি কিটোর একটি উপাসনালয়ে দর্শনার্থীদের ধর্মীয় উপদেশও দিতেন।
১৯৭৪ সালে উপাসনালয়টি তিনি নিজেই স্থাপন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে তার অনুসারী ছিল তিন লাখের বেশি।
নিজের জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি ইতিহাসের কুখ্যাত নারীদের জীবন নিয়েও তিনি লিখতেন। এসব কারণে কেউ কেউ তাকে ‘চটি লেখিকা’ হিসেবেও ডাকতেন।
সেতাওশির সবচেয়ে সাড়া জাগানো কাজ ছিল ‘দ্য টেল অব জেনঝি’-এর আধুনিক সংস্করণ বের করা। ২২০০ পৃষ্ঠার সুবিশাল এই উপন্যাসের আগের সংস্করণটি ছিল মূলত একাদশ শতকের একটি রোমান্টিক কাহিনি।
এই কাহিনীকে পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা ছাড়াও জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসও বলে থাকেন অনেকে। সেতাওশির অনুবাদ সংখ্যাটি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হলে এর ৩৫ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়।
১৯৭২ সালে জাকুশো সেতাওশি। পরের বছরই ৫১ বছর বয়সে বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী জীবন বেছে নেন তিনি। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস
১৯২২ সালের ১৫ মে জাপানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় তকুশিমায় জন্ম নেয়া সেতাওশির বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি এবং মা গৃহিনী।
টোকিওতে নারীদের একটি কলেজে জাপানি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা সেতাওশি ১৯৪৩ সালে নয় বছরের সিনিয়র ইয়াসুশি স্যাকাওকে বিয়ে করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বেযুদ্ধের ডামাডোলে ১৯৪৪ সালে স্বামীকে চীনের বেইজিংয়ে নিযুক্ত করা হলে তিনিও সেখানেই অবস্থান করেন এবং কন্যা মিচিকোর জন্ম দেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগেই জাপানে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আমেরিকান বোমার আঘাতে মারা যান সেতাওশির মা।
জাপানের একটি পত্রিকায় মায়ের স্মরণে একটি লেখা দিয়েই লেখালেখির জীবন শুরু তার। ১৯৪৬ সালে জাপানে ফিরলেও পরের বছরই তার সংসার ভাঙে। স্বামী ও কন্যাকে রেখে সেসময়ই তিনি কমবয়সী এক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। পরের দিকে কন্যাকে ছেড়ে যাওয়ার ব্যপারটিকে তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় অনুশোচনার কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
কম বয়সী প্রেমিকের সঙ্গেও খুব বেশিদিন ছিলেন না সেতাওশি। ১৯৫০ সালে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে তিনি বেশ কয়েকজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হন। এসব সম্পর্কের ঘটনাপ্রবাহ ও যৌনতার বিষয়গুলো তার উপন্যাসগুলোতে উঠে এসেছে।
১৯৫৭ সালে একটি উপন্যাসের জন্য সাহিত্য পুরস্কার জিতে নেন সেতাওশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই জাপানি নারীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়েই মূলত উপন্যাসটি লেখা হয়।
পরের বছর ‘দ্য কোর অফ অ্যা ফ্লাওয়ার’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হলে তা নিয়ে বেশ শোরগোল তৈরি হয়। উপন্যাসের কাহিনিটি ছিল- স্বামীর বসের সঙ্গে এক নারীর সম্পর্ক নিয়ে। পরে উপন্যাসটিকে সমালোচকরা ‘চটি বই’ আখ্যা দিলে তিনিও কড়া ভাষায় মন্তব্য করেন, ‘যারা এসব বলছে, তারা আসলে পুরুষত্বহীন, আর তাদের স্ত্রীরা নির্জীব।’
জীবনের শেষ দিনগুলোতেও নিজের প্রতিষ্ঠিত উপাসনালয়ে দর্শনার্থীদের উপদেশ বাণী শুনিয়ে গেছেন সেতাওশি। ছবি: জাপান টাইমস
এভাবে নানা চড়াই উৎরাই শেষে ১৯৭৩ সালে ৫১ বছর বয়সে পুরোপুরিভাবে বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নেন সেতাওশি। সন্ন্যাসিনী হলেও মদ কিংবা মাংসের মতো পার্থিব কিছু সুখ তিনি কখনোই ছাড়েননি।
কিটোতে তিনি একটি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়। তবে এসব দর্শনার্থীর বেশিরভাগই ছিলেন নারী। সম্পর্ক এবং আত্মা নিয়ে সেতাওশির উপদেশ তারা মন দিয়ে শুনতেন।