বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিসের কারণে ব্লিডিং হচ্ছে জানিয়ে তার চিকিৎসায় গঠিত দলের মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকরা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার সুপারিশ করেছেন।
তারা জানিয়েছেন, বিএনপি নেত্রীর যকৃৎ বা লিভারে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একবার এই রক্তক্ষরণ সামাল দেয়া গেছে। তবে এখন তার যে অবস্থা, সেটি আবার সামাল দেয়া কঠিন হবে।
বাংলাদেশে দুই থেকে তিনবার রক্তক্ষরণ সামাল দেয়ার কারিগরি সুযোগ নেই দাবি করে যত দ্রুত সম্ভব তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা।
রোববার সন্ধ্যায় বিএনপি নেত্রীর গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় ব্রিফিং করেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা। তারা দাবি করেন, বেগম খালেদা জিয়ার যে রোগ হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিক অল্প কয়েকটি বিশেষায়িত সেন্টারে তার চিকিৎসা সম্ভব। বাংলাদেশে এই চিকিৎসার কারিগরি সুযোগ সুবিধা যেমন নেই, তেমনি ওষুধও নেই।
আরও চার মাস আগে বিএনপি নেত্রীকে বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে তার শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হতো না বলেও দাবি করেন খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় দলের গঠন করা মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান।
দণ্ডবিধির ৪০১ ধারা ব্যবহার করে দুর্নীতির দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনের দণ্ড স্থগিত করিয়ে ২০২০ সালের মার্চে তার মুক্তির ব্যবস্থা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময়ই শর্ত ছিল তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
তবে মুক্ত হওয়ার পর বিএনপি নেত্রীর স্বজনরা সরকারের কাছে একাধিকবার তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। গত এপ্রিলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এক দফা সেই দাবি নাকচ করে সরকার।
সম্প্রতি খালেদা জিয়াকে আবার হাসপাতালে নেয়া হলে এই দাবি আবার তুলে ধরে তার স্বজন ও দল। সরকার এবারও নাচক করলে বিএনপি শুরু করে আন্দোলন কর্মসূচি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মাঝে দাবি করেছেন, তাদের নেত্রী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন। বিদেশে পাঠাতে দেরি হলে তাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে, এমন দাবিও করেন তিনি।
তবে বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের নেত্রীর অসুস্থতা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয় হয়নি। তার চিকিৎসা চলা ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে কোনো কিছু বলেনি।
ব্রিফিংয়ে বিএনপি নেত্রীর রোগ নিয়ে প্রাথমিক একটি বর্ণনা দেন ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের গঠন করা মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান এফ এম সিদ্দিকী।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পেট থেকে চাকা চাকা রক্ত যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ইউনাইটেড হাসপাতালে একবার রক্ত দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে। কিন্তু এ ধরনের রোগীকে বারবার রক্ত দেয়া সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা করছি, আবার যদি ব্লিডিং হয়, তাহলে যদি এটাকে কন্ট্রোল করা সাপোর্ট করা যাবে না। ব্লিডিং হয়ে মৃত্যুঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।’
এফ এম সিদ্দিক এই চিকিৎসায় টিপস নামে একটি পদ্ধতির উল্লেখ করেন, যার সুযোগ সুবিধা উন্নত বিশ্বে আছে।
ইন্টারভ্যানশনাল গ্যাস্ট্রো অ্যানালিস্ট চিকিৎসক শামসুল আরেফিন লিভারে রক্তক্ষরণ ঠেকাতে চিকিৎসা পদ্ধতি তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা যে সকল রোগীদের ডিল করি তাদের দুই/তিন বার ব্লিডিং এর পরে সারভাইভ করানো যায় না। এর জন্য আমেরিকা, ইউরোপ বেস্ট। বিশেষত ইউকে জার্মানি এবং ইউএসএ। ওইসব দেশে এগুলোর জন্য অ্যাডভানস সেন্টার আছে। তবে সেসব দেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। দুই-চারটা সেন্টার আছে। বিশ্বের সব রোগীরা সেসব সেন্টারে যায়।’
টিপস্ হিসেবে এফ এম সিদ্দিকী যা উল্লেখ করেছেন, তার ব্যাখ্যা কী- জানতে চাইলে শামসুল আরেফিন বলেন, ‘লিভারের ভেতরে পোর্টাল প্রেসার কমানোর জন্য সিস্টেমিক সার্কুলেশন এবং পোর্টাল সার্কুলেশনের মধ্যে একটা কমিউনিকেশন করে দেয়া। এটা একটি হাইলি টেকনিক্যাল কাজ। এটা সচরাচর হয় না। আমি দেখি নাই টিপস্ করা রোগী আমাদের দেশে আসছে।’
এই পর্যায়ে চিকিৎসার যে সুযোগ-সুবিধা দরকার, দেশে তার অভাব আছে বলে উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার এই চিকিৎসক বলেন, ‘বিল্ডিং হলে আমাদের কিছু কিছু স্পেশাল কেমিক্যাল এজেন্ট আছে। এই কেমিক্যাল এজেন্টগুলো আমরা সেখানে ইনজেক্ট করি। আনফরচুনেটলি সেই ওষুধটা আমাদের দেশে এই মুহূর্তে এভেইলেবল না।’
এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) হিমোগ্লোবিন লেভেল প্রথমবার নেমে গিয়েছিল ৫ দশমিক ৫ এ। পরে আমরা সেটাকে চার ব্যাগ রক্ত দিয়ে ৯-১০ এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার সেটা কমে এসেছিল ৭ দশমিক ৮ এ। ‘ওনার ব্লিডিং-এর একটা ইম্পরট্যান্ট ব্যাপার হচ্ছে অনেক রক্ত দিয়ে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে পারবেন না। তাহলে সেটা আবার রিব্লিট করবে। এ কারণে হিমোগ্লোবিনকে একটা লেভেলের মতো ধরে রাখতে হয়।
‘আবার যদি রিব্লিডিং হয় তবে সে বিল্ডিংকে কন্ট্রোল করার মতো বা বন্ধ করার মতো সাপোর্টেড টেকনোলজি আমাদের এখানে নেই। সেক্ষেত্রে ব্লিডিং হয়ে ওনার মৃত্যুঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বিল্ডিংটা এখন বন্ধ হয়ে আছে। যে রিব্লিড করে ধরে নিতে পারেন সে আবার রিব্লিড করবে। সেই রিব্লিডিং এর চান্স আগামী ছয় সপ্তাহে হওয়ার সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ থেকে এর অধিক। তার মানে আপনাকে ধরে নিতে হবে রিব্লিড করবে। এজন্য আমরা অনেকটা অসহায় ফিল করছি।’
আবার রক্তক্ষরণ হলে কী বিপদ হতে পারে, তা উল্লেখ করে এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা যে রক্ত দেখেছি এরকম ব্লিডিং হলে যার হার্ট ফেইলর… হিমোগ্লোবিন কমে যায়, যার ডায়বেটিস আছে এবং এতো জটিলতার মধ্যে কিডনির ডিজিজ আছে ওনার… এনাল ফেইলর হয়ে যায়, এটাকে আমরা কীভাবে সাস্টেইন করব, যদি প্রেশারটা টিপস দিয়ে না কমাতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল অথরিটিকে জানিয়েছি, তারা ওনাদের (খালেদা জিয়া) রিলেটিভদেরকে জানিয়েছিলেন। কারণ এখনো সময় আছে।’
‘হাসপাতালে রক্তবমি’
এফ এম সিদ্দিকী বলেন, উনি গত ১২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় চলে এসেছিলেন। বাসায় আসার পর কিছুদিন ভালো ছিলেন। এরপর হঠাৎ খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। কয়েক কদম হাঁটতে গিয়েই হাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
তখন রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় বিএনপি নেত্রীর রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। এরপর তাকে এভারকেয়ারে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালে নেয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রক্তবমি হয় বলেও জানান তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি ম্যাডামের যদি পুনরায় রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার মতো সাপোর্টিং টেকনোলজি আমাদের এখানে নেই। সে ক্ষেত্রে উনার আবার রক্তক্ষরণ হলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।’
১৭, ১৮ নভেম্বরের পর আবারও দফায় রক্তক্ষরণ হয়েছে খালেদা জিয়ার। তবে শেষ ২৪ ঘণ্টায় হয়নি বলে জানান তিনি।
বলেন, ‘আবার এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। সে কারণে স্ট্যাবল অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা জার্মানিতে উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রে তার চিকিৎসা দরকার।’
বিদেশে নিতে দেরি হলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে উল্লেখ করে এফ এম সিদ্দিকী বলেন, ‘নেক্সট উইকে ফিফটি পারসেন্ট, নেক্সট সিক্স উইকে সেভেনটি পারসেন্ট এবং এরপর যদি আল্লাহ না করুন এটা একটা অবভিয়াস ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে।
‘আমরা যা করছি, তা সমস্ত সম্ভাবনার শেষটুকু দিয়ে। যেটা এ উপমহাদেশের মধ্যেও নেই। যতবার তিনি আক্রান্ত হচ্ছেন, কেন যেন তার সিরিয়াসনেসটা একেবারে ডেথ পয়েন্টে চলে যাচ্ছে।’
বিএনপি নেত্রীর চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, এ কিউ এম মহসিন, নূর উদ্দিন, আল মামুনও ব্রিফিংয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন।