পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি ফ্যামিলি টেক্সের পুনগঠিত পরিচালনা পর্ষদে নতুন করে তিন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন শেয়ারধারী পরিচালক ও একজন স্বাধীন পরিচালক।
নতুন পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ-ই মোস্তফা ও তাবাসুম করিমকে শেয়ারধারী পরিচালক হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। শামসুজ্জামান নামে একজনকে স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি নতুন পরিচালনা পর্ষদ ও কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়েছে গত ২৪ নভেম্বর।
যে দুজনকে শেয়ারধারী পরিচালক করা হয়েছে, তাদের কাছে কোম্পানির মোট শেয়ারের ৪ শতাংশের বেশি রয়েছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
ফ্যামিলি টেক্সের পুনর্গঠন করা পর্ষদের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সমীর কুমার শীল মনে করেন, বিএসইসির এই সিদ্ধান্ত কোম্পানিটিতে প্রাণের সঞ্চার করবে এবং সেটি আবার মুনাফায় ফিরবে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত কোম্পানিটির জন্য ভালো হয়েছে। কারণ, কোম্পানিটি কীভাবে চালালে ভালো হবে তা নতুন দুই শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ভালো বলতে পারবেন। কোম্পানিটি পুরোদমে চালুর ব্যাপারে আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে আন্তরিক।’
তিনি বলেন, ‘বিএসইসি যখন মিরাজ-ই মোস্তফার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে নতুন বোর্ড করে দিয়েছিল, তখন তাদের কার্যক্রমে কিছুটা বাধা এসেছিল। ব্যাংকের লেনদেনে বড় ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বোর্ড কোম্পানিতে গিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে এসেছিলাম। এখন তারাই যেহেতু বোর্ডে আছে, সেহেতু তাদের দায়িত্ব এখন বেড়ে গেছে। আশা করি, তাদের সহযোগিতায় আমরা কোম্পানিটিকে আবারও মুনাফায় নিয়ে আসতে পারব।’
গত ফেব্রুয়ারিতে ফ্যামিলি টেক্সের বোর্ড পুর্নগঠন করে দেয় বিএসইসি। তারপরও অনেকবার আলোচনায় আসে কোম্পানিটি আর চালু করা সম্ভব হবে না। বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম এমনও বলেন যে, তারা কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। পরে কারখানা বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন।
কিন্তু সেপ্টেম্বরের শুরুতে পুনর্গঠন করা বোর্ডের সদস্যরা পরিদর্শন করেন ফ্যামিলি টেক্সের কারখানা। সেখান থেকে ফিরে তারা জানালেন, কোম্পানির সক্ষমতার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদনে। সবশেষ খবর আসে, কোম্পানিটির উৎপাদন বাড়তে কাজ করছে উদ্যোক্তারা।
তার আগেই মালিকানায় থাকা মিরাজ-ই মোস্তফা কোম্পানিটির তার তত্ত্বাবধানে চালু রাখতে চান বলে জানান নতুন বোর্ড সদস্যদের। কোম্পানি চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের ব্যবস্থা করে দিলে তিনি আগের মতোই উৎপাদন শুরু করতে পারবেন বলে জানানো হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি)।
নতুন পর্ষদ এ বিষয়ে বিএসইসিকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে একটি প্রতিবেদনও দেয় গত সেপ্টেম্বরে। দুই মাস পর্যবেক্ষণের পর এই সিদ্ধান্ত নিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
এরই মধ্যে কোম্পানিটি তার উৎপাদনক্ষমতার ৫০ শতাংশ কাজে লাগাচ্ছে এবং তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচালক মিরাজ-ই-মোস্তফা।
গত সেপ্টেম্বরে চিটাগং ইপিজেডে ফ্যামিলে টেক্সের কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে সেটি চালু থাকতে দেখেন বিএসইসির পুনর্গঠিত বোর্ডের সদস্যরা
৯ বছর আগে তালিকাভুক্ত হওয়ার এক বছর পর ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়ে চমক দেখালেও পরে হতাশ করে বিনিয়োগকারীদের। টানা লোকসানের পাশাপাশি উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ঘোষণা না দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে করে দেয়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন বিনিয়োগকারীরা।
এই অভিযোগ ওঠার পর বিএসইসি তদন্ত কমিটি গঠন করে পরিচালকদের জরিমানাও করে, কিন্তু জরিমানা পরিশোধ করা হয়নি। বরং সে সময় জানা গিয়েছিল, মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ করে লাপাত্তা।
বিএসইসি বন্ধ ও লোকসানি ১৬টির বেশি কোম্পানিতে প্রাণ ফেরাতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে একটি এই ফ্যামিলিটেক্স।
ফ্যামিলি টেক্সের জন্য বিএসইসির মনোনীত পরিচালক হলেন কাজী আমিনুল ইসলাম, ড. সমীর কুমার শীল, ড. গাজী মোহাম্মদ হাসান জামিল, ড. মো. জামিল শরিফ, শরিফ এহসান এবং ড. মো. ফরজ আলী।
ছয়জন পরিচালকের মধ্যে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফরজ আলী।
ফ্যামিলিটেক্সের আদ্যোপান্ত
২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। ১০ টাকা মূল্যমানের সাড়ে তিন কোটি শেয়ার ছেড়ে তারা সংগ্রহ করে ৩৫ কোটি টাকা।
তালিকাভুক্তির পর ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক হিসাব পর্যালোচনা করে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। তবে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ।
ওই বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় দেখানো হয় ৭ টাকা ২৬ পয়সা আর শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য হয় ২১ টাকা ৭২ পয়সা। এই লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন ১ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ার দর দাঁড়ায় ৬২ টাকা, যদিও একপর্যায়ে দাম ৭৪ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল।
বিপুল পরিমাণ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর থেকেই ফ্যামিলি টেক্সের আয় কমতে থাকে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সমাপ্ত অর্থবছরে তারা সবশেষ মুনাফা করেছিল। তখন শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৮২ পয়সা। এর পরের চার বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে তারা।
২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় সাড়ে ৪ পয়সার মতো। পরের বছর লোকসান হয় ৭ পয়সা, ২০১৯ সালে লোকসান হয় ৮ পয়সা। আর ২০২০ সালে লোকসান হয় ১৫ পয়সা।
২০১৩ সালে ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেয়ার পরের বছর তারা দেয় আরও ১০ শতাংশ বোনাস। এর পরের তিন বছর দেয় ৫ শতাংশ করে। কিন্তু গত দুই বছর কোনো লভ্যাংশই দেয়া হয়নি।
অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে কোম্পানির আয় ক্রমেই বাড়ছিল। তালিকাভুক্তির আগে তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয় বিএসইসিতে।
সেখানে দেখা গিয়েছিল ২০১১ ও ২০১২ সালে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছিল চার গুণের বেশি। আর তালিকাভুক্ত হওয়ার বছরে মুনাফা বাড়ে আরও ৭৬ শতাংশ।
গত বছর কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ১৫ পয়সা করে লোকসান দেয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিক অর্থাৎ ছয় মাসে লোকসান দিয়েছে ১৩ পয়সার কিছু বেশি।
এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকরা আরেকটি আইনবিরুদ্ধ কাজ করেন। পুঁজিবাজারে ঘোষণা না দিয়েই উদ্যোক্তা-পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দেন।
এই বিষয়টি তদন্তে ডিসেম্বরের শেষে একটি কমিটি করে বিএসইসি। তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে কি না, সেটি এখনও জানা যায়নি। আর এ জন্য পরিচালকদের তেমন কোনো শাস্তিও পেতে হয়নি।
কোম্পানিটির ৩৫ কোটি ৪০ লাখ শেয়ারের মধ্যে এখন মাত্র ৪.০২ শতাংশের মালিক কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। অথচ বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তত ৩০ শতাংশ শেয়ার ধরে রাখতে হবে মালিকপক্ষ।
এই কোম্পানির ৭৭.৫৭ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা কোম্পানির শেয়ার দরও একেবারে তলানিতে। একপর্যায়ে দাম ২ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে আসে। তবে বোর্ড পুনর্গঠনের পর গত আগস্টে দাম বেড়ে একপর্যায়ে ৬ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত পৌঁছে। তবে গত এক মাস ধরে আবার কমছে। রোববার দাম দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৪০ পয়সা।