বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মেয়র আব্বাসের উত্থান যেভাবে

  •    
  • ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ২২:৩৩

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, ২০০২ সালের পর আব্বাস আলী যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেন। এর তিন বছরের মাথায় তিনি মহানগর যুবলীগের সহসভাপতি পদ পেয়ে যান। এর পর থেকে তিনি রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে তিনি উপরে উঠে আসেন।

বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল বসানোয় আপত্তি তোলা রাজশাহীর কাটাখালীর নৌকার মেয়র আব্বাস আলীকে দলে অনুপ্রবেশকারী বলেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। তার রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশে আব্বাসকে নৌকা প্রতীক দিতে সুপারিশ করেছিলেন তারা।

বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ইস্যু নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ার পর ওই সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন এখন আব্বাসের শাস্তি দাবি করছেন। আর আব্বাস বলছেন, তিনি বিপদে পড়েছেন, এ জন্য তাকে ঘিরে অপপ্রচার চলছে। তিনি দলে সব সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিই করেছেন।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ২০০২ সালের পর আব্বাস আলী যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেন। এর তিন বছরের মাথায় তিনি মহানগর যুবলীগের সহসভাপতি পদ পেয়ে যান। এর পর থেকে তিনি রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে থাকেন। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বিরোধে। এরই জেরে ২০০৭ সালে তিনি যুবলীগের সহসভাপতি পদ থেকে বহিষ্কৃত হন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মেরাজউদ্দিন মোল্লা। আব্বাস তার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেন এবং কাটাখালী এলাকায় নিজের আধিপত্য পাকাপোক্ত করেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। পশুর হাটের ইজারাসহ শ্যামপুর বালু মহাল দখলের অভিযোগ ওঠে তার বিরদ্ধে।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আয়েন উদ্দিন। তখন মেরাজ উদ্দিন মোল্লা হন বিদ্রোহী প্রার্থী। নৌকার প্রার্থী আয়েন উদ্দিনের বিপক্ষে মাঠে ছিলেন আব্বাস ও তার সমর্থকরা। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায় আব্বাস বাহিনী।

নির্বাচনে আয়েন উদ্দিন বিজয়ী হলে আব্বাস আবার তার অবস্থান পাল্টান। এমপি আয়েনও তাকে কাছে টেনে নেন নিজের অবস্থান শক্ত করার আশায়। ফলে এমপি বদল হলেও আব্বাসের আধিপত্য থেকেই যায়। এর সুবাদে দলে কোনো পদে না থাকলেও ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর কাটাখালী পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যান আব্বাস আলী। মেয়র হওয়ার পর তার প্রতাপ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয় আব্বাসের। এই সময়ে তার বেপরোয়া আচরণে ক্ষুব্ধ হলেও ত্যাগী নেতা-কর্মীরা হয়ে যান নিরুপায়।

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর ২০১৮ সালে কাটাখালী পৌর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটি (আহ্বায়ক কমিটি) দেয়া হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক হন আব্বাস।

২০২০ সালের পৌরসভা নির্বাচনে একটি বড় অংশ তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। মেয়র আব্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি তারা। সেবারও আওয়ামী লীগের টিকিট পান মেয়র আব্বাস। দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়ে আব্বাস হয়ে যান লাগামহীন। নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও তিনি থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

পৌরসভা ভবনে শুক্রবার প্রতিবাদ সভায় কাউন্সিলররা মেয়র আব্বাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন। ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মঞ্জুর রহমান বলেন, ‘রাজস্ব আদায় বাবদ পৌরসভার ফান্ডে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ছিল। অথচ এখন চা খাওয়ার টাকাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে পৌর ফান্ডের টাকা গায়েব হয়ে গেছে। বিষয়টি আমি দ্রুত তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন অনুদান দেয়ার জন্য কাটাখালী বাজারের কাপড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করেন মেয়র আব্বাস। কিন্তু সে টাকা কাউকে দেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

‘কারোনাকালে চা দোকানদারদের অনুদান দেয়ার নামে কয়েক লাখ টাকা পৌরসভার ফান্ড থেকে হাতিয়ে নেন মেয়র। কিন্তু কোনো চায়ের দোকানদার করোনাকালে অনুদান পাননি।’

৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল মজিদ জানান, পৌরসভার কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩৬ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া আছে। ফান্ডে টাকা থাকার পরও মেয়র আব্বাস এই বেতন-ভাতা দেননি। তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জোর করে বিভিন্ন কাগজে সই করতে বাধ্য করেন। কেউ সই না করলে তাকে চাকরিচ্যুতিসহ নানা হুমকি দেন।

তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ করলে কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গালিগালাজ করতেন মেয়র। আত্মীয়-স্বজনদের নামে ঠিকাদারী লাইসেন্স করে নগর অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ মেয়র নিজে করতেন। আত্মীয়-স্বজনদের নামে হাট-ঘাট ও যানবাহনের টোল আদায়ের ইজারা নিয়েছেন। এসব টোল আদায়ের নামে নিজের লোকজন দিয়ে চাঁদাবাজি করেন।’

পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘মেয়র ভোটের পর থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে চলেন না। তার সঙ্গে থাকেন বিএনপি নেতারা। কৃষি প্রণোদনাও পায় বিএনপি নেতারা। তার আপন ভাই বিএনপি করে। অন্য এক পক্ষের ভাই করে জাতীয় পার্টি।’

কাঁটাখালি পৌরসভার যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জনি ইসলাম বলেন, ‘মেয়র বিভিন্ন জায়গা দখল করেছেন। স্কুলের জমি দখল করে তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তা তৈরি করছেন। জমি দখল করে তার বাবার নামে স্কুল করেছেন। পৌরসভার বিভিন্ন এলাকার দোকানদারদের হয়রানি করে চাঁদাবজি করেছেন। সরকারি খাল দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন।’

শুক্রবার ফেসবুক লাইভে এসে কাঁদেন রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী

কাটাখালি পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোত্তালেব বলেন, ‘মেয়রের অপকর্মের শেষ নেই। একেবারে জিরো থেকে হিরো। প্রথম মেয়র হওয়ার সময় তেমন টাকা ছিল না, অথচ এখন এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক।’

তিনি বলেন, ‘৯০ সালের দিকে তিনি (আব্বাস) জাতীয়তাবাদী তরুণ দল করতেন। তারপর তিনি জাতীয় পার্টি করতেন। গোপনে গোপনে জামায়াতের সঙ্গে তার আঁতাত ছিল। তার প্রমাণ হচ্ছে ২০১১ সালের নির্বাচনে দলীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে বিদ্রোহী হওয়া। ওই নির্বাচনে তিনি নিজেও হারেন, দলীয় প্রার্থীকেও হারান। জিতে যান জামায়াতের নেতা।’

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের কাছে বৃহস্পতিবার আব্বাসের উত্থান প্রসঙ্গে জানতে চান সংবাদ কর্মীরা। এ সময় তিনি জানান, তাকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়নপত্র দেয়ার দায়িত্ব আসলে মহানগর আওয়ামী লীগের নয়। এটি কেন্দ্রীয় কমিটি যাচাই-বাছাই করে দেয়। এখানে জেলা আওয়ামী লীগের হয়তো সুপারিশ থাকে। এভাবে হয়তো সুপারিশের ভিত্তিতে নৌকা পেয়ে থাকতে পারেন।

ডাবলু সরকার বলেন, ‘আমরা জানি, আব্বাসের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার এক ভাই হত্যা মামলার আসামি। তার ভাই যুবদল করে। আমাদের বুঝতে দেরি হয়েছে, তিনি একজন অনুপ্রবেশকারী।’

কার ছত্রছায়ায় তিনি আওয়ামী লীগে প্রবেশ করলেন, দলীয় মনোনয়ন পেলেন, সে বিষয়ে তদন্ত হবে বলেও জানান ডাবলু সরকার।

জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনিল কুমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে জানান, ওই সময় কে বা কারা তাকে দলে ঢোকাল, কার সুপারিশে আব্বাস আলী নৌকার মনোনয়ন পেল, এটা তারও প্রশ্ন। তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই সময়ে পৌর আওয়ামী লীগ এবং থানা আওয়ামী লীগের রেজুলেশনে মনোনয়নের জন্য চার জনের নামের তালিকা দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে আব্বাসের নাম এক নম্বরে দিয়েছিল তারা। আমি আর জেলা সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সম্পাদক, কাটাখালী পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক বসেছিলাম।

‘তখন এমপি আয়েন উদ্দিন বলল, আব্বাসকে দিলে আমরা জিততে পারব। প্রস্তাবিত চার জনের নামই আমরা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই তাকে মনোনয়োন দেয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকেই তাকে দেয়া হয়েছে। আমাদের কাছে যে প্রস্তাব এসেছিল সেই প্রস্তাবগুলো আমার শুধু বাহক হিসেবে পৌঁছে দিয়েছি কেন্দ্রে।’

মেয়র আব্বাস আলীর উত্থানের জন্য অনেকে দায়ী করেন রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আয়েন উদ্দিনের ভূমিকার। তবে আব্বাসের অডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে তার শাস্তির দাবি করেন এমপি আয়েন।

দলে তার অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা তো অনেক সময় বুঝতে পারি না। যদি বুঝতেই পারতাম...তাহলে জাতির পিতাকে হারাইতাম না। খন্দকার মোশতাকের অনুসারীরা অনেক সময় অনেক ঘটনা ঘটায়। সেটি শুধু দলের নয়, দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখজনক ঘটনা।’

আয়েন বলেন, ‘এটাও সত্য তার (আব্বাস) ভাই যুবদল করত। সে অন্য দলের সঙ্গে জড়িত ছিল। আপনারা নিশ্চই জানেন, এক ভাই বিএনপি করে, এক ভাই আওয়ামী লীগ করে - এটি দেশের অনেক জায়গাতেই আছে। সংসদ সদস্য নির্বাচনে রহিম ভরসা, করিম ভরসার মতো দুই ভাই দু দলের হিসেবে কাজ করেন। আমাদের দলের নেতাকর্মীরা হয়তো সেটি মনে করেছে।’

অভিযোগের বিষয়ে মেয়র আব্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পৌরসভার ফান্ড থেকে টাকা নেয়ার প্রশ্নই আসে না। অনুপ্রবেশকারী নয়, আমি শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি। এখন আমাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে।’

এ বিভাগের আরো খবর