সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে তিন দিনের মাথায় দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যে গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যু হয়, সেই গাড়িটি দুই হাত ঘুরে লাইসেন্সবিহীন এক চালকের কাছে ছিল।
লাইসেন্স ছাড়া সিটি করপোরেশনের চালকরা কীভাবে গাড়ি চালান, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশ সেগুলো চেক করে কি না, সেটি নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের গাড়ি আইন অমান্য করে চলছে। এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় কি না, এমন প্রশ্নে ট্রাফিকের কয়েকজন কর্মকর্তা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিনের বেলা সিটি করপোরেশনের একটি ট্রাক বেপরোয়া গতিতে ইউটার্ন নিচ্ছিল, চালকের কানে ছিল মোবাইল। গাড়িটি আমি আটকাই এবং কাগজ যাচাই করি। কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি চালক। তার গাড়ি আটকানোর পর আমি বিপদে পড়ি। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে একের পর এক কল। সঙ্গে যুক্ত হয় আমাদের কর্মকর্তাদের কল। তারাও ছেড়ে দিতে বলেন। কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই আমাকে ছাড়তে হয়।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আমার স্যারদের বলে চালককে এক ঘণ্টা বসিয়ে কাউন্সেলিং করাই। এতে আরও হিতে বিপরীত হলো। সকালে অফিসে এসে দেখি আমার অফিসের সামনে ময়লা ফেলে গেছে সিটি করপোরেশনের গাড়ি। যে ময়লা সারা দিনেও তাদের ফোনের পর ফোন দিয়ে সরানো সম্ভব হয়নি।’
রাজধানীর কলাবাগান মাঠের পাশে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন আবর্জনার সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন। ছবি: নিউজবাংলা
সিটি করপোরেশনের গাড়ি বা চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়টা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ বলে দাবি করেন এক ট্রাফিক কর্মকর্তা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িগুলো সেভাবে চেক করা হয় না বলে জানান তিনি। চেক করা বা ব্যবস্থা নেয়া হলে ওপর থেকে প্রচুর চাপ আসার কথা স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।
লাইসেন্স ছিল না চালক হারুনেরও
নটর ডেম শিক্ষার্থী নাঈমকে চাপা দেয়া সিটি করপোরেশনের গাড়িটি বরাদ্দ ছিল চালক ইরান মিয়ার নামে। তিনি গাড়িটি না চালিয়ে দেন হারুন মিয়াকে। আর হারুনের হাত ঘুরে গাড়িটি ছিল রাসেলের কাছে। রাসেল চালকের আসনে থাকা অবস্থায় ময়লা বহনকারী গাড়িটির ধাক্কায় মারা যান নাঈম।
সিটি করপোরেশনের প্রকৃত চালক ইরান মিয়া বাদে বাকি দুজনের গাড়ি চালানোর কোনো ধরনের লাইসেন্স ছিল না। তারাই পালাক্রমে চালাচ্ছিলেন গাড়িটি (গাড়ি নং ১১-১২৪৪)। ইরান মিয়ার নামে বরাদ্দ করা গাড়ি কীভাবে হারুন ও রাসেল চালাচ্ছিলেন, তার কোনো জবাব দিচ্ছে না দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সারওয়ার জাহান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টা শর্ষের মধ্যে ভূতের মতো অবস্থা। যারা অঘটন ঘটান, তারা যেভাবে দায়ী, এর বাইরে যারা এসব বিষয় তদারকিতে থাকেন, তাদেরও গাফিলতি রয়েছে।
‘সিটি করপোরেশনের ত্রুটির বিষয়টা পরপর দুটি ঘটনায় আবারও সামনে এসেছে। ময়লা বহনকারী গাড়ির ধাক্কায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রকৃত চালক গাড়িটি চালাচ্ছে কি না, তা যেমন সিটি করপোরেশন তদারকির কথা তেমনিভাবে রাস্তায় থাকা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব সেগুলো চেক করা। কোনোটাই ঠিকমতো হয় না বলে প্রাণহানির মতো ঘটনাগুলো ঘটছে।’
বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো উচিত বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্জ্য আনা-নেয়ায় ব্যবহৃত গাড়িগুলো অত্যন্ত আধুনিক। জাপান সরকারের দেয়া। কোনো ধরনের কারিগরি জ্ঞান ছাড়া অদক্ষ লোক দিয়ে সেগুলো চালানো হচ্ছে। দিনে গাড়ি চলার কথা না, সেটাও চলছে। আইন না মেলে হরহামেশাই উল্টো পথে যাচ্ছে এবং দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুরো ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে দক্ষ জনবল দিয়ে এই ব্যবস্থাপনা করা উচিত। যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়।’
কলাবাগান স্টেশন থেকে ময়লা নেয়নি সিটির ট্রাক
গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটির গাড়ির চাপায় নাঈম নিহতের পরদিন পান্থপথে উত্তর সিটির গাড়ির চাপায় মারা যান আহসান কবির খান। বৃহস্পতিবার রাতেই চালক মোহাম্মদ হানিফের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে চালককে শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
উত্তর সিটি করপোরেশনের গাড়ির চাপায় একজন মারা যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে কলাবাগান সেকেন্ডারি ট্রান্সফার সেন্টার থেকে কোনো ময়লা সরানো হয়নি।
শুক্রবার বিকেলে ওই সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, ট্রান্সফার সেন্টারের ভেতরে প্রতিটি কনটেইনার ময়লায় পূর্ণ।
সেন্টারের ভেতরে থাকা শ্রমিকরা জানান, বৃহস্পতিবার সড়ক দুর্ঘটনার পর রাতে আর কোনো ট্রাক ময়লা নিতে আসেনি। চালককে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।
বাসা বা প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যানে করে ময়লা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার সেন্টারে নিয়ে আসেন আকাশ নামে এক শ্রমিক। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে কথা হয় তার সঙ্গে।
আকাশ বলেন, ‘কাইলকা রাইত ১২টা লাগাত বইসা রইছি। কোনো ট্রাক আয় নাই। আজকে আইব কি না জানি না।’
২৭ নম্বর সড়কের পাশে একটি ময়লা বহনকারী ট্রাককে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘কাইলকা দুপুর থেইক্কা এই ট্রাকটা এইহানেই আছে। ড্রাইভার কই খবর নাই। শুনছি, বসুন্ধরার সামনে ঘটনার পর থেইক্কা ড্রাইবাররা পলাইছে।’
বৃহস্পতিবার রাতে কেন ময়লা নিতে কোনো ট্রাক আসেনি, এ বিষয়ে জানতে ওই সেকেন্ডারি স্টেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদের সেখানে পাওয়া যায়নি।
সেকেন্ডারি সেন্টারটিতে দক্ষিণ সিটির ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের ময়লা জমা করা হয়, যা রাতে ট্রাক এসে নিয়ে যায়। এই দুই ওয়ার্ডের কমিশনারদের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে তাদের ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
কঠোর হচ্ছে পুলিশ
গুলিস্তানে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান মৃত্যুর পর করপোরেশনের গাড়ি অন্যায় করলে কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ।
ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান রমনা ট্রাফিক জোনের সহকারী কমিশনার মো. রেফাতুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘কাউকে কোনো ছাড় না দিয়ে যিনি আইন অমান্য করবেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আমাদের সে ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। সেভাবেই আমরা কাজ করছি।’
এত সব অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে দুই সিটি করপোরেশন বলছে, দুই মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ, দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত করা এবং এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধের করণীয় সম্পর্কে জানা যাবে।
বুধবার গুলিস্তান হল মার্কেটসংলগ্ন সড়কে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে মারা যান নাঈম হাসান। ঘটনাস্থল থেকেই গাড়িটির চালকের আসনে থাকা রাসেল মিয়াকে আটক করে পুলিশ। পরবর্তী সময়ে পল্টন থানায় নাঈমের বাবা শাহ আলমের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে। রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশ জানায়, রাসেলের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাসেল মাস্টার রোলে একসময় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন। তিন রিমান্ডে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্তকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, ‘রাসেল মাঝে মাঝেই বিভিন্ন রুটে ট্রিপ দিতেন। তিনি হারুনের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিতেন। প্রতি ট্রিপে তিনি পেতেন ১০০ টাকা।’
এদিকে হারুনকে শুক্রবার যাত্রাবাড়ী থেকে হারুনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩। বিকেলে পল্টন থানার পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
হারুনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাব-৩-এর অপারেশনস অফিসার বীণা রানী দাস জানান, ২০২০ সাল থেকে হারুন ময়লাবাহী এই গাড়িটি নিয়মিতভাবে চালিয়ে আসছেন। ২৪ নভেম্বর তিনি অনুপস্থিত থাকার কারণে সহকারী মো. রাসেল গাড়িটি চালান। হারুন এবং রাসেল দুজনেরই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।