দেশে পেঁয়াজ বা ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চালের দাম বাড়লে এর সরবরাহ বৃদ্ধি এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। একইভাবে আলুর দাম বাড়লে দায় কৃষি মন্ত্রণালয় এবং লবণের ক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়।
পণ্যমূল্যে স্থিতিশীলতা অর্জন অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণা প্রতিরোধের গুরুদায়িত্ব পালন একক কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়।
এ কারণে বাজারে পণ্যের দামে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় ছাড়াও মৎস্য ও পশুসম্পদ, যোগাযোগ, রেল, নৌপরিবহন ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, মাঠ-প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও বিশেষ ভূমিকা থাকে।
দেশে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে একক কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নেই, যদিও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মূলত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপরেই বর্তায়। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের কার্যক্রমের সমন্বয় প্রতিষ্ঠায় পৃথক কোনো বিভাগ নেই।
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সার্বিক মূল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সার্বক্ষণিক সব ধরনের কার্যক্রমের সমন্বয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আগাম করণীয় নির্ধারণ ছাড়া কোনো বিকল্পও নেই। স্বাধীনতা-উত্তরকালেই দেশ পুনর্গঠনের সময় এটি উপলব্ধি করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কারণে তিনি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য মন্ত্রণালয়ে বিজনেস অ্যাফেয়ার্স এবং কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স নামে পৃথক দুটি ডিভিশন সৃষ্টি করেছিলেন।
প্রতিবেশী দেশ ভারতও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সন্তোষজনক এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ‘কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্স, ফুড অ্যান্ড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন’ নামে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছে।
দেশেও কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন খোলার প্রস্তাব
এমন প্রেক্ষাপটে পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকারকে স্বাধীনতা-উত্তরকালীন বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে দেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণকারী বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সম্প্রতি সংগঠনের সভাপতি গোলাম রহমান এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে চিঠি পাঠিয়েছেন।
চিঠিতে তিনি কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স ও বিজনেস অ্যাফেয়ার্স নামে মন্ত্রণালয়ে পৃথক দুটি ডিভিশন সৃষ্টি করার প্রস্তাব রেখেছেন। দাবি করেছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন নামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি ডিভিশন সৃষ্টি করা হলেই কেবল মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এসব দায়িত্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে।
প্রস্তাবের যৌক্তিকতা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
গত কয়েক বছরে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯, প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে এসব আইন বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন বিভাগ, কমিশন ও কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু এসব উদ্যোগের পরও ভোক্তাদের অধিকার, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা হয়নি, ব্যবসায়িক প্রতারণা রোধ করা যায়নি। উল্টো নিয়ন্ত্রণ দিনদিন দুরূহ হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বল্প আয় ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য ১৫ থেকে ২০টি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা সময়ের দাবি। মুক্তবাজার পরিবেশে ভোক্তাদের কল্যাণ ও জীবনমানের উন্নয়নের বিষয়টি বহুলাংশে পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা ও ব্যবসায়িক নৈতিকতার ওপর নির্ভরশীল। আবার মন্ত্রিপরিষদে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সাথেও অনেক ক্ষেত্রে ভোক্তা স্বার্থ জড়িত থাকে। নেপথ্যে থেকে এসব কাজ সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ মন্ত্রণালয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য পৃথক ডিভিশন না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন ও বিজনেস অ্যাফেয়ার্স নামে মন্ত্রণালয়ে পৃথক ডিভিশন সৃষ্টি করা হলে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা জনস্বার্থমূলক হবে।’
সরকার কী ভাবছে
বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনায় রপ্তানি শাখা, এফটিএ, আইআইটি, ডিটিও, প্রশাসন এবং ডব্লিউটিও সেলসহ ছয়টি উইং রয়েছে।
মূলত দ্রব্যমূল্য নিয়ে কাজ করে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি অনুবিভাগ (আইআইটি)। এর অধীনে আরও একটি সেল (দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস) রয়েছে, যারা দেশে তেল, চিনি, পেঁয়াজ, চালসহ অত্যাবশ্যকীয় ১৭ পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি, মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এবং এসব পণ্যের সংকটের পূর্ভাবাস দেয়।
এ ছাড়া ট্যারিফ কমিশনও পণ্যভিত্তিক মাসিক গবেষণা প্রতিবেদন দেয়। এভাবে বর্তমানে মন্ত্রণালয় দেশে দ্রব্যমূল্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে।
কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন খোলার প্রস্তাব সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভোক্তা ও ব্যবসায়িক উভয় স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে মন্ত্রণালয়ও চায় যেকোনো ভালো উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে। সেই লক্ষ্য অর্জনের কার্যক্রমকে গতিশীল করে তুলতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
‘বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি অনুবিভাগের (আইআইটি) কার্যক্রম একই সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। এটি আরও গতিশীল ও সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি এই দুই কার্যক্রমকে পৃথক করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এখন ক্যাবের কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স নামে পৃথক ডিভিশন খোলার প্রস্তাবটিও অনেকটা একই রকম। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। তবে পুরো মন্ত্রণালয়কে দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রক্রিয়াটি অনেক উচ্চতর প্রক্রিয়ার বিষয়। আমরা সেখানেও আলোচনা তুলে ধরব।’