পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনা নিয়ে মতভিন্নতা, শেয়ারের দর বেড়ে গেলেও এক্সপোজার লিমিট অতিক্রম করে গেলে জরিমানা, বন্ডে বিনিয়োগ পুঁজিবাজারের বিনিয়োগসীমার মধ্যে থাকবে কি না, এই নিয়ে বিতর্কের মধ্যে গত পাঁচ কর্মদিবস ধরে পুঁজিবাজারে টানা দরপতন হচ্ছে।
এর মধ্যে এই বৈঠকটি ডাকার কথা নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আগামী মঙ্গলবার এই বৈঠক হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি চিঠি ইস্যু করেছে বলে জেনেছি। তবে বিস্তারিত কিছু জানি না।’
বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, তারা এক্সপোজার লিমিট, বন্ডে বিনিয়োগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করবেন।
কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, বৈঠকে পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা, পুঁজিবাজারের জন্য গঠিত বিশেষ তহবিলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ জমা, পুঞ্জীভূত লোকসান থাকলে শুধু সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া ও বন্ডের বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়গুলো আলোচনা করা হবে।
পুঁজিবাজার নিয়ে বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় সভা প্রতিবছরই হয়। গত ১৮ মার্চ শেষবার দুই পক্ষ একসঙ্গে বসেছিল। সেই বৈঠকের পর বিএসইসির পক্ষ থেকে যে বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে দেয়া হয়, তার অনেকগুলোই পরে বাস্তবায়ন হয়নি।
সেই বিষয়গুলো ছাড়াও গত ৯ মাসে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মতভিন্নতা তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া বাজার সংশোধনের মধ্যে দুই সংস্থার মতভিন্নতার কারণে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। গত সপ্তাহে সংশোধন কাটিয়ে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিলেও চলতি সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসই সূচকের পতন ঘটল। সেই সঙ্গে কমে গেছে লেনদেন।
বড় বিনিয়োগকারী বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে বলেই ধারণা করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এ অবস্থায় দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই বৈঠকের খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরাতে পারে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমা নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। একদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ তহবিলের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে বিশেষ পদ্ধতিতে গণনার কারণে শেয়ার দর বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগসীমা পেরিয়ে যাওয়ার কারণে গুনতে হচ্ছে জরিমানা।
আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। আর শেয়ারের ধারণকৃত মূল্য নির্ধারণ করা হয় বাজারমূল্যের ভিত্তিতে। আর এখানেই বিপত্তি।
ব্যাংক তার বিনিয়োগসীমার মধ্যেই শেয়ার কিনলেও তার দাম বেড়ে গেলে বাজারমূল্যের ভিত্তিকে বিনিয়োগ গণনার কারণে বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে আগেভাগেই। এতে পুঁজিবাজারে বিক্রয় চাপ তৈরি হচ্ছে। এর ফলে বাজারে হচ্ছে দরপতন।
এমনিতেই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অভাবে ভুগতে থাকা পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলো নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় গেছে, সেটি বাজারে দরপতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যেটি দেখা যাচ্ছে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে পুঁজিবাজারে উত্থানে সূচক বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এতে বিনিয়োগকারীরা হাতের হারিয়ে ফেলা টাকা ফিরে পেতে শুরু করে।
তবে এক দশক পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে মূলত ব্যাংকের শেয়ারের বিক্রয় চাপে সূচকের নিম্নগতি দেখা দেয়।
এই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলোকে হাতের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিতে বাধ্য করেছে। এর ফলে দরপতনের বৃত্ত থেকে বের হতেই পারছে না পুঁজিবাজার। শেয়ার দর কমে আসায় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
এর মধ্যে আবার বন্ডের বিনিয়োগও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিনিয়োগসীমার মধ্যে ধরছে। অথচ বিএসইসি এই বিনিয়োগকে ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখার পক্ষে। তারা বলছে, সারা বিশ্বেই এই বন্ডে বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বাইরে থাকে।
সরকার পুঁজিবাজারে বন্ড মার্কেটকে জনপ্রিয় করতে চাইছে। এর অংশ হিসেবে সুকুক বন্ড ছেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা তুলতে অনুমতি দিয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডকে। আকর্ষণীয় মুনাফার এই বন্ডে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করেছে। আর বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করে যায় বলে ব্যাংকগুলো হাতের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যারা করেনি, তাদের জরিমানার শিকার হতে হয়েছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম সরাসরি বলেছেন, বন্ডে বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সীমার বাইরে থাকা উচিত, সারা বিশ্বেই এই রীতি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছে বলেই তিনি মনে করেন।
এক্সপোজার লিমিট গণনার ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্যে এটি বিবেচনার কথা তিনি কয়েক মাস ধরেই বলে আসছেন। গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরবর্তী সমন্বয় বৈঠকে বিষয়টি তোলা হবে। তবে এই বৈঠক আহ্বান করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেই উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি।
এই দুটি বিষয় ছাড়াও আরও দুটি বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতভিন্নতার তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত লভ্যাংশ নিয়ে যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, তাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবণ্টিত লভ্যাংশ জমা দিতে রাজি ছিল না বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের যুক্তি, এটি আমানতকারীদের টাকা। তবে বিএসইসি বলছে, লভ্যাংশ আমানতকারীদের টাকা নয়।
আবার ওয়ান ব্যাংকের লভ্যাংশ ইস্যুতেও আছে মতপার্থক্য। গত অর্থবছরে কোম্পানিটি যে লভ্যাংশ দিয়েছে, তা বার্ষিক সাধারণ সভায় পরিবর্তন করতে বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিএসইসি বলছে, লভ্যাংশ কী হবে, সেটি শেয়ারধারীদের সিদ্ধান্তের বিষয়। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবর্তন করার নির্দেশ দিতে পারে না।