সরকারের তথ্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। আর বিবিএসের সবচেয়ে বড় কার্যক্রম জনশুমারি, কিন্তু এবারের ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ শীর্ষক প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খাচ্ছে।
বেশি দামে ট্যাব (ট্যাবলেট কম্পিউটার) কেনা, দরপত্রে কঠিন শর্ত আরোপসহ বেশ কিছু বিষয় সমালোচিত হওয়ায় এবং করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পটির কাজ এখনও শুরুই করা যায়নি। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, চলতি বছরে যে সময় আছে, তাতে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে কি না।
জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের জন্য ট্যাব কেনার প্রস্তাব দুইবার বাতিল করে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা। এরপর প্রায় এক মাস পার হলেও প্রস্তাব আর ওঠেনি।
প্রতি ১০ বছর পর সরকার জনশুমারি পরিচালনা করে থাকে। সেখানে এ বছরের মধ্যেই শুমারি করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে ট্যাব কেনাতেই আটকে আছে শুমারির কার্যক্রম।
শুমারির আওতায় ট্যাব কিনতে বিবিএসের সর্বশেষ দরপত্রের শর্ত হিসাবে প্রস্তাব অনুমোদনের পর ট্যাব সরবরাহে কমপক্ষে দেড় মাস সময় লাগার কথা। আবার গণনাকারীদের এসব ট্যাব চালানোর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যাপারও রয়েছে। তবে হাতে সময় মাত্র এক মাস।
কবে নাগাদ জনশুমারি শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিবিএসের মহাপরিচালক মো. তাজুল ইসলাম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা শুমারির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। এটা হবে সামনে। আমরা ট্যাব কেনার প্রস্তাব সিসিজিপিতে (ক্রয় কমিটি) পাঠিয়েছি। এটা পাস হলে তারপরে শুমারি শুরুর সময় বলা যাবে। যন্ত্রপাতি না পেলে তো আর শুমারি করা যাবে না।’
এ বছরের (ডিসেম্বর) মধ্যে শুমারি করা সম্ভব হবে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এখনই কনফার্ম করতে পারতেছি না। কারণ প্রস্তাব পাস হলেই পরে প্রাথমিক কিছু কাজ আছে, তারপর ঠিক কত দিনে ট্যাব হাতে পাব, আর কবে শুমারি শুরু করতে পারব, এসব বিষয় ঠিক হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জনশুমারির সম্ভাব্য তারিখ ধরে তা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছি। তিনি অনুমোদন দিলেই শুমারি হবে। বাকিটা নির্ভর করবে ট্যাব হাতে পাওয়ার ওপর। কারণ এবারের শুমারিতে ডিজিটালি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও তা সংরক্ষণ করা হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ক্রয় কমিটির সভায় ট্যাব কেনার প্রস্তাবটি দ্বিতীয় দফায় উত্থাপিত হতে পারে।
তবে আগের দুই দফার মতো এখনও বিবিএসের প্রস্তাবে ত্রুটি রয়ে গেছে বলেই জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র। এ জন্য প্রকল্পের সংশোধন প্রয়োজন হতে পারে বলেও জানিয়েছে সূত্রটি।
বিবিএস বলছে, চলতি বছরের মধ্যেই শুমারি শুরুর আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ জন্য প্রথমে গত ২ থেকে ৮ জানুয়ারি জনশুমারি করার কথা ছিল, যা করোনার কারণে পিছিয়ে যায়। পরে চলতি মাসের ২৫ থেকে ৩১ অক্টোবর করার সিদ্ধান্ত হয়। ট্যাব জটিলতায় তা শুরু করা যায়নি। ট্যাব কেনার প্রস্তাব অনুমোদন ও প্রধানমন্ত্রীর সায় পেলে ২৪ থেকে ৩০ ডিসেম্বর শুমারি সপ্তাহ ধরে জনগণনা করার কথা ছিল, কিন্তু তা আর সম্ভব নাও হতে পারে।
আগে জনশুমারির নাম ছিল আদমশুমারি। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘পরিসংখ্যান আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী ‘আদমশুমারি ও গৃহগণনার নাম পরিবর্তন করে ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’ করা হয়।
নানা সমালোচনার পরও দেশের ষষ্ঠ এ জনশুমারিকে ডিজিটাল শুমারি আখ্যা দিয়ে এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪ লাখ ট্যাব কিনতে চায় বিবিএস। শুমারি প্রকল্প আগেই অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
পরবর্তী ধাপে প্রকল্পের কেনাকাটা সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য তুলতে হয়। কিন্তু পর পর দুইবার বিবিএসের প্রস্তাব ফেরত পাঠায় কমিটি।
শুরু থেকেই এ প্রকল্পে ট্যাব কেনা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। সবশেষ দরপত্রে শর্ত অনুযায়ী বিবিএসকে দরপত্র আহ্বানের দেড় মাসের মধ্যে সব ট্যাব হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দরপত্র খোলার পাঁচ দিন পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ট্যাব সরবরাহ শুরু করতে হবে।
বিবিএসের এমন কঠিন শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এমন শর্ত আরোপ করেছে বলেও অভিযোগ আছে। ট্যাব কেনার জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলেও মাত্র দুটি দরপত্র জমা পড়ে। তার মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে বেশি ব্যয়ের দরদাতাকে কাজ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রীর দপ্তরেও নানা বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে একাধিক চিঠি এসেছে।
গত ২৩ জুন আহ্বান করা বিবিএসের দরপত্রের ভিত্তিতে ট্যাব কেনার প্রস্তাব প্রথমবার গত আগস্টে উপস্থাপন করা হয় ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে। তবে দরপত্রে ‘ত্রুটি’ থাকায় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পুনরায় দরপত্র আহ্বানে বিবিএসকে নির্দেশনা দেয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী ফের দরপত্র আহ্বান করে বিবিএস, কিন্তু সেখানে আরোপ করা হয় কঠিন কিছু শর্ত। দ্বিতীয় দফায় পুনঃপ্রস্তাবও বাতিল হয় একই অভিযোগে।
সবশেষ গত ২৭ অক্টোবর প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পর প্রায় এক মাস পার হলেও এখনও অনুমোদনের জন্য এ প্রস্তাব ক্রয় কমিটিতে তোলা হয়নি।
দরপত্রের শর্তে অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে ‘বিগত তিন বছরে শুধু একটি একক চুক্তির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছে।’
তবে এ শর্তে বেশির ভাগ দেশীয় প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাই দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ৪০০ কোটির পরিবর্তে তা ৫০ কোটিতে নামিয়ে আনার কথা বলছে। তা ছাড়া ৪ লাখ ট্যাবই একক লটে কেনার কথা বলা হয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, একক অন্তর্ভুক্ত না করে কয়েকটি লটে বিভক্ত করে সুষম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ দেয়া হলে অধিক প্রতিষ্ঠান কাজের সুযোগ পাবে।
অভিযোগ আরও রয়েছে, বড় পর্যায়ে কোনো কাজ করতে হলে আগে পাইলটিং করতে হয়। এর আগে বিবিএসের এনএসডি প্রকল্পের আওতায় রংপুর ও নীলফামারীতে ট্যাবের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের পরীক্ষা করা হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রকল্পে ট্যাব ব্যর্থ হয়। তারপরও ট্যাব দিয়ে শুমারি করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।