বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়াসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে বামপন্থি আট ছাত্র সংগঠন। এসব দাবি পূরণ না হলে আগামী সোমবার থেকে রাজধানীর শাহবাগে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণাও দিয়েছে তারা।
বামপন্থি আট ছাত্র সংগঠনের অন্য দুটি দাবি হচ্ছে, জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানো এবং বর্ধিত বাস ভাড়া প্রত্যাহার।
ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়া’র যুক্তি হিসেবে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন এসব বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের নেতারা। সেই সঙ্গে তারা বলছেন, শিক্ষাব্যবস্থার পুরোটাই ভর্তুকিনির্ভর হতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নির্মিত রাস্তায় চলাচল করে বলে শিক্ষার্থীদের ভাড়া কম নেয়া হলেও মালিক-শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি অনিক রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমত আমরা চাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি হবে সর্বজনীন এবং সেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর যাবতীয় ব্যয় মেটানো হবে সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে। আমাদের কাছে হাফ ভাড়ার দাবিটি অনেকগুলো দাবির মধ্যে একটি।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই পর্যাপ্ত যানবাহনের ব্যবস্থা থাকা উচিত বলেও মনে করছেন এই নেতা। তিনি বলেন, ‘আমরা তো চাই না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে সাধারণ কোনো পরিবহনে চড়তে হবে। আমরা চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহনে শিক্ষার্থীরা যাওয়া-আসা করবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কাজটি করা জরুরি, কিন্তু আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন।’
ইতিহাসের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জন্য যে হাফ ভাড়া, সেটি ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া গিয়েছিল আইয়ুব সরকারের সময়। কিন্তু সেই জিনিসের বাস্তবায়ন আমরা বাংলাদেশে পাচ্ছি না।’
দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনিক।
শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার সঙ্গে বাসশ্রমিক স্বার্থের কোনো বিরোধ নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘এখানে মূল সমস্যা সরকারের সিদ্ধান্তের। ডিজেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখলাম একটি নাটকের পর পরিবহনের ভাড়া বেড়ে গেল। এরই মধ্য দিয়ে নতুন করে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ইস্যুটি সামনে এলো। যেটা যৌক্তিক ইস্যু।’
শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া নিলে পরিবহন মালিকেরা রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি চাইতে পারেন কি না- সে বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বামপন্থি ছাত্রনেতারা। বাসের পরিচালন ব্যয় সম্পর্কে নিজস্ব জরিপ না থাকলেও তারা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস থাকলেও বাসমালিক-শ্রমিকেরা ক্ষতির মুখে পড়বেন না।
ছাত্র ফ্রন্টের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ রানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস কিন্তু চলছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নির্মিত রাস্তায়। সেই জনগণের একটি বিশেষ অংশ হিসেবে যদি ছাত্রদেরকে বিবেচনা করি, তাহলে সেই ছাত্রদের জন্য কোনো সুযোগ রাখলে মালিকদের লাভ হবে না এমন কিন্তু না। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকারি পরিবহন সার্ভিস বেশি করে বাড়াতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের হাফ ভাড়া বা সব বিষয়ে কম খরচের দাবিটি কিন্তু সব সময়ই ছিল। সেই আইয়ুব সরকারের সময় থেকেই। প্রথমত আমরা মনে করি, এই দায়িত্ব সরকারের। আমরা এখনও কিন্তু দাবি জানাচ্ছি জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হবে, সরকারি বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, ভর্তুকি দিতে হবে।’
ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফার মতে, পরিবহন একটি সেবা খাত। সেখান থেকে ‘অসীম মুনাফা’ করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, ‘পরিবহন তো সেবা খাত, এটা ব্যক্তিমালিকানায় সরকার দিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিমালিকানায় থাকলেও তার একটা পরিমিত মুনাফা করা উচিত। এটা দিয়ে জিম্মি করে একদম কোটিপতি হওয়ার প্রতিযোগিতা তো কাম্য নয়। সরকারের সব সুবিধা ব্যবহার করে তারা ব্যবসা করছেন। জনগণের প্রতি তাদের একটা দায় আছে। সড়ক তো জনগণের টাকা দিয়ে তৈরি হচ্ছে, সেখানে বাস নামিয়ে তারা ব্যবসা করছেন।
‘সবচেয়ে বড় কথা এটা পুরোনো দাবি। আইয়ুব খানের আমল থেকেই এই দাবি ছিল। আর বাসের একটা ট্রিপে কয়জন ছাত্র থাকে? তাতে কতটা লোকসান হয়ে যায়? ছাত্ররা তো দেশের ভবিষ্যৎ, তাদের প্রতি সমাজেরও তো একটা ইনভেস্টমেন্টের দায় আছে।’
শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে হাফ ভাড়ার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, ছাত্র ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বিপ্লব ছাত্র-যুব আন্দোলন।
বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দাবি, তাদের আন্দোলন পরিবহনসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নয়। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা অনিক রায় বলেন, ‘বাসের যে হেলপার বা ড্রাইভার বা পরিবহনশ্রমিক কিন্তু আমার মতোই একজন ভুক্তভোগী, কিন্তু আমাদেরকে বরাবরই মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বাইরের একটা সিন্ডিকেট।’
বামপন্থি সংগঠন হিসেবে পরিবহনশ্রমিকদের জন্য বিশেষ কোনো কর্মসূচির উল্লেখ করতে না পারলেও অনিক বলেন, ‘করোনার সময়ে শুধু বাসশ্রমিকদের জন্য আলাদা করে আমাদের কোনো কাজ ছিল না। তবে আমরা সব পেশার শ্রমিকদের জন্য আমাদের সাধ্যমতো খাদ্যসহায়তা, অর্থসহায়তা করেছি। সে সময় আমরা শ্রমিকদের আলাদা ভাতা দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম।’
ছাত্র ফ্রন্টের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের মুখোমুখি, এটা একদমই ঠিক নয়। ছাত্র সংগঠন হিসেবে আমরা যে আলাদাভাবে বাসশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছি এমনটা না, কিন্তু করোনাকালীন সমস্ত সেক্টরের শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশেষ প্রণোদনা, রেশন দেয়ার কথা আমরা বলেছি। আমাদের মতো করে সাহায্য করেছি।’
ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমাদেরকে পরিবহন শ্রমিকদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা চলছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। তারা তো এই ভাড়া ঠিক করেন না, ভাড়া ঠিক হয় মালিক পর্যায়ে।’
তিনি বলেন, ‘করোনার সময়ে আলাদাভাবে পরিবহনশ্রমিকদের জন্য আমরা কিছু করিনি। তবে নিম্ন আয়ের বা সব মানুষের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে করার চেষ্টা ছিল।’