দেশে বিত্তবানদের সংখ্যা বাড়লেও বাস্তবতা হচ্ছে, এদের কাছ থেকে খুব কমই কর আদায় হয়। আইন অনুযায়ী, বাড়ি-গাড়িসহ ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে নিয়মিত আয়করের সঙ্গে অতিরক্তি কর দিতে হয়, যা ‘সারচার্জ’ নামে পরিচিত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে, দেশে এমন করদাতার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। অর্থাৎ মাত্র ১৫ হাজার লোক সারচার্জ দিতে সাড়া দিয়েছেন।
দেশে বর্তমানে ৬২ লাখ কর আয়কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। সে হিসাবে তাদের মধ্যে মাত্র দশমিক ২৫ শতাংশ সারচার্জ দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা বেড়েছে এমন বিত্তবানের সংখ্যা ৭৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
সরকারি হিসাবে এ তথ্য দেখানো হলেও বাস্তবে দেশে কোটিপতির সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি বলে ধারণা করা হয়।
এনবিআরের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ১৪ হাজার ৭০০ করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন, যাদের ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। এর বিপরীতে কর আদায় হয়েছে সোয়া ৫০০ কোটি টাকা।
সারচার্জ এক ধরনের ‘অতিরিক্ত’ কর। ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে কারও বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট ইত্যাদির সূত্রে নির্দিষ্ট সীমার বেশি সম্পদ থাকলে প্রদেয় আয়করের সঙ্গে প্রযোজ্য হারে সারচার্জ দিতে হয়। করদাতা তার বার্ষিক আয়কর রিটার্নের সঙ্গে এই কর দিয়ে থাকেন। একে ‘সম্পদজনিত কর’ও বলা হয়।
ধরা যাক, কোনো করদাতার আয়কর এসেছে বছরে ৫০ হাজার টাকা। আর সম্পদের জন্য সারচার্জ ধার্য হয়েছে ২০ হাজার টাকা। তা হলে ওই ব্যক্তির মোট কর হবে ৭০ হাজার টাকা। যার যত বেশি সম্পদ, তিনি তত বেশি কর দেবেন।
বাস্তবে ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদশালী লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। রাজধানী, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় অনেকেই বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। তারা বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ, পোরেশে, লেক্সাসের মতো দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে চড়েন। এসব এলাকায় বেশির ভাগ ফ্ল্যাটের দামই তিন কোটি টাকার ওপরে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে অর্ধেক সম্পদ। সে হিসাবে এখনও বেশির ভাগ সম্পদশালী সারচার্জ আওতার বাইরে।
২০২০ সালের মে মাসে আর্থিক বিষয়ে পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সম্পদধারীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ শীর্ষে। ওই সময়ে দেশে ৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদধারী ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
অভিযোগ রয়েছে, অনেকে নিজের নামে সম্পদ দেখান না কিংবা বেনামে সম্পদ রাখেন। অর্থাৎ আয়কর ফাইলে তা প্রদর্শন করেন না।
দেশের সব বড় বড় কোম্পানির পরিচালক বা মালিকেরা বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) নিবন্ধিত। এনবিআরের বার্ষিক প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এলটিইউর ৫২৪ জন করদাতা বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দিয়েছেন। এদের মধ্যে মাত্র ২৯৮ জন বড় করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন। অথচ এসব বড় কোম্পানির মালিকেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন, কিন্তু সারচার্জ এড়িয়ে যান।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে কর ব্যবস্থা এখনও করবান্ধব নয়। আইনে নানা জটিলতা ও অসংগতি আছে। আইন প্রয়োগে ঘাটতি আছে। এসব কারণে অনেক সক্ষম ব্যক্তিকে কর জালে আনা যাচ্ছে না।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ি ভাড়া থেকে যে পরিমাণ কর আহরণ হয়, তা খুবই নগণ্য। তার কারণ এ খাতের তথ্য এনবিআর ঠিকমতো সংগ্রহ করতে পারে না। একবার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি।
‘একটা জানা আয়ের উৎস থেকে কর আহরণ করা গেল না। তেমনি চিকিৎসক, প্রকৌশলীরা ঠিকমতো তাদের আয় প্রদর্শন করেন না। তার মানে এনফোর্সমেন্টের অভাব আছে। এখানে নজর দিতে হবে। কর ব্যবস্থাকে আরও সহজীকরণ করতে হবে।’
কেন সম্পদশালীদের কাছ থেকে সারচার্জ আদায় করা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সারচার্জ নিয়ে বিতর্ক আছে। এই কর আদায়ে বাজারমূল্য বিবেচনা করা হয় না। ফলে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও অনেকে সারচার্জের আওতার বাইরে থাকেন, যা বৈষম্যমূলক।’
আমিনুর রহমান উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘একটি সম্পদের বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকা হলে দলিল মূল্য ১০ কোটি টাকা দেখানো হয়। ফলে ৯০ কোটি টাকাই অপ্রদর্শিত থেকে যায়।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়ি, জমি, অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি দেখানো হয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হিসেবে। আইনে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ক্ষেত্রে কর আদায় হয় না। এসব কারণে সারচার্জে সাড়া কম।
সারচার্জ আদায়ের চিত্র
২০১১-১২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সারচার্জ দেয়ার বিধান করা হয়। তখন অবশ্য ২ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সারচার্জ দিতে হতো। ওই বছর ৪ হাজার ৪৪৬ জন করদাতা তাদের সম্পদের ওপর সারচার্জ দেন। তখন কর আহরণ হয়েছিল ৪৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
এরপর থেকে সারচার্জ আদায় বাড়লেও আশানুরূপ নয়। ২০১২ -১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৬২ জন সারচার্জ দেন এবং কর আহরণ হয় ৬০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সারচার্জ দেন প্রায় ১১ হাজার জন। কর আদায় হয় ২৫৪ কোটি টাকা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ হাজার ৯২৭ জন করদাতা ২৮৮ কোটি টাকা সারচার্জ দেন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ হাজার ৬৭০ জন করদাতার কাছ থেকে ৩৬০ কোটি টাকা সারচার্জ পায় সরকার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৩ হাজার করদাতা সারচার্জ দেয় এবং তা থেকে কর আহরণ হয় ৪১০ কোটি টাকা।