দেশে প্রথমবারের মতো ‘ক’ শ্রেণির মাদক ডিমেথোক্সিব্রোমোএমফেটামিন (ডিওবি) উদ্ধার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
এলএসডি কারবারিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর সময় নতুন মাদকটি পান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
তারা জানান, মাদকসেবীদের কাছে প্রতি ব্লট ডিওবি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এটি সেবনে ‘তৃতীয় নয়ন’ খুলে যায় বলে দাবি মাদকসেবীদের।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা জানান, ডিওবি সেবনকারীকে যেকোনোভাবে প্রভাবিত করা যায়। সেবনকারী নির্দেশিত কাজ করতে উদ্যমী হয়ে ওঠে। এর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করতে হয়। বেশি পরিমাণে সেবন করলে মৃত্যু হতে পারে।
এই কারবারের সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তারা হলেন আসিফ আহমেদ শুভ ও তার বন্ধু অর্ণব কুমার শর্মা। এ ছাড়া সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের খুলনার বয়রা বাজার শাখার ম্যানেজার মামুনুর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খুলনায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উত্তরের কার্যালয়ে মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, “এই ডিওবি আমাদের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত নিষিদ্ধ মাদক। ডিওবি অনেকটা এলএসডির মতো দেখতে হলেও আরও বেশি ক্ষতিকর। অতিরিক্ত সেবনে মৃত্যুও হতে পারে।”
পোল্যান্ড থেকে শুভর বাসায়
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ডার্ক ওয়েবসাইট থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে ২০০ ব্লট ডিওবি কেনেন খুলনার যুবক আসিফ আহমেদ শুভ। অর্ডার করার পর ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চালানটি সরাসরি তার বাসায় পৌঁছায়।
অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান বলেন, “বিমানবন্দরগুলোতে উন্নতমানের স্ক্যানার না থাকায় কুরিয়ারে আসা ডিওবি ধরা পড়েনি। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে এই মাদক অর্ডার করার পর এক মাসের ব্যবধানে শুভর বাসায় কুরিয়ারের মাধ্যমে তা পৌঁছে যায়। স্ক্যানারে ধরা না পড়লেও বিদেশ থেকে এলএসডির মতো মাদক আসতে পারে এমন তথ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে ছিল। গত আগস্ট মাসে কী ওয়ার্ড ‘stash’ শব্দটি পান গোয়েন্দারা। এরপর চলে অনুসন্ধান। তিন মাসের বেশি সময় অনুসন্ধানের করার পর এই মাদকের সন্ধান মিলেছে।”
অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উত্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, ‘বিমানবন্দরগুলোতে শক্তিশালী স্ক্যানার নেই এটা সত্য, তবে আমাদের নজরদারি ছিল। নজরদারি থাকার কারণে এই মাদক আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি।’
ডিওবির ক্রেতা খুলনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
গ্রেপ্তারের সময় শুভর বাসায় এলএসডি আর অর্ণবের বাসায় পাওয়া যায় ডিওবি। পোল্যান্ড থেকে আসা ডিওবির ব্লটগুলো অর্ণবের বাসায় রাখা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে শুভ জানান, তিনি দুই মাস আগে ২০০ ব্লট ডিওবি নিয়ে আসেন। সেগুলো তিনি নিজে সেবন করতেন এবং মাদকসেবীদের কাছে বিক্রি করতেন। নতুন ক্রেতা তৈরি করতে কিছু ব্লট বিনামূল্যেও দিয়েছেন তিনি।
অভিযানে থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুভ পোল্যান্ড থেকে দুই শতাধিক ডিওবি এনেছিলেন। আমরা অভিযানের সময় তার কাছে পেয়েছি ৯০টি। বাকিগুলো তারা বিক্রি ও সেবন করেছে।’
খুলনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ডিওবি বিক্রির জন্য শুভর বিক্রেতা রয়েছে বলে জানান হেলাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫-৬ জন সেলার আছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে একজন সেলার।’
পাচারে জড়িত কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা
খুলনা থেকে মাদক কারবারি দুজনের সঙ্গে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের বয়রা শাখার ব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পার্সেল পাঠাতেন।
গোপনে ক্রেতা সেজে পাঁচ ব্লট এলএসডির অর্ডার করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। খুলনা থেকে কোনো বাধা ছাড়াই রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের সুন্দরবন শাখায় পার্সেলটি পৌঁছায়।
প্রযুক্তির সহায়তায় প্রেরক শুভর সন্ধান পান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তবে যিনি পার্সেলটি পাঠিয়েছেন তার মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র রাখেননি খুলনার বয়রা শাখার দায়িত্বশীলরা। আর তা করা হয়নি মাদক কারবারিদের সঙ্গে মামুনুর রশীদের যোগসাজশের কারণে।
এ বিষয়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রেরকের মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র রাখার কথা কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
কাগজের পাতায় এলএসডি পার্সেলের বিশেষ চেম্বার
ঢাকা থেকে অর্ডার করা এলএসডির পার্সেলটি পৌঁছানোর পর গোয়েন্দারা ওই পার্সেলে এলএসডি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কারণ যে পার্সেলে এলএসডি পাঠানো হয়েছে, তাতে এসেছে কয়েকটি পেজ। এর মধ্যে কোথাও এলএসডির ব্লট নেই। তবে পেজগুলো অধিকতর যাচাই-বাছাই করার পর একটিতে বিশেষ চেম্বার খুঁজে পান কর্মকর্তারা। এর মধ্যে পাঁচ ব্লট এলএসডি লুকানো ছিল। কাগজের পাতার মতো পাতলা এবং সিম কার্ডের মতো ছোট হওয়া ওই বিশেষ চেম্বারে লুকানো ছিল এলএসডির ব্লটগুলো।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পার্সেলটি পাওয়ার পর হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ এর মধ্যে এলএসডি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওরা কয়েকটি পেজ পাঠিয়েছিল, যেগুলোর একটিতে বিশেষ চেম্বার করে এলএসডি লুকানো ছিল।’
অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘বিমানবন্দর এবং কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে উন্নত স্ক্যানার স্থাপনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়েছি। দেশে মাত্র একটি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের স্ক্যানার রয়েছে। বাকিদের কাছে যে ধরনের স্ক্যানার আছে, তাতে এ ধরনের মাদক ধরা পড়ে না।’