দেশে করোনা চিকিৎসায় ৮০ শতাংশই অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয়েছে বলে সম্প্রতি এক সমীক্ষা উঠে আসছে। রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে পরিচালিত এক গবেষণা এমন তথ্য উঠে আসছে।
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার না কমলে করোনার মতো আরেকটি মহামারির আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। একইসঙ্গে এই মহামারি রুখতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগী ও চিকিৎসক সবাইকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) আয়োজনে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ শীর্ষক এক সেমিনারে এই গবেষণা তথ্য প্রকাশ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধের ৭০ শতাংশই ছিল অ্যান্টিবায়োটিক। আর আইসিইউতে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ। এর মধ্যে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও সেফ্টরিয়াক্সন ব্যবহার হয়েছে ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ। আর হাসপাতালে ভর্তির আগে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এগুলো ব্যবহার করেছেন ৩৩ শতাংশ রোগী।
এ বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘দেশে করোনা চিকিৎসায় ৮৭ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ এর ৮০ শতাংশই ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয়েছে। ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন দেশেই অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার হয়েছে বলে জানান তিনি।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের কারণে ক্রমেই কমে আসছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। কমে এসেছে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতাও। এতে দ্রুত কার্যক্ষমতা হারাতে বসেছে বাকি সব ধরনের ওষুধ। করোনা সংক্রমণের মধ্যে যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দেখা দিয়েছে এটাও অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব। বেড়ে যাচ্ছে ডায়াবেটিসও।
মঙ্গলবার আইইডিসিআর কার্যালয়ে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ শীর্ষক সেমিনারে গবেষণা তথ্য প্রকাশ করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ওপর সম্প্রতি আইইডিসিআর ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (এএসএম) যৌথভাবে আরেকটি গবেষণা চালায়। করোনা চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড পাঁচটি ও সাধারণ পাঁচটি হাসপাতালকে এই গবেষণার জন্য বেছে নেয়া হয়। হাসপাতালগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটে অবস্থিত। এগুলোর মধ্যে পাঁচটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি।
এই গবেষণার অংশ হিসাবে চলতি বছরের ১ মে থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই গবেষণাতেও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।
গবেষকরা বলেছেন, ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার রোগীদের অনাবশ্যক আর্থিক চাপে ফেলছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সম্প্রতি অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার ও অপব্যবহারের কারণে ব্যাকটেরিয়ার কিছু স্ট্রেইন তাদের ডিএনএতে সামান্য পরিবর্তন এনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ‘সুপারবাগে’ রূপান্তরিত হয়েছে।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে এতো বেশি অ্যান্টিবায়োটিক উপযোগী নয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা না থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক একেবারেই ব্যবহার করা উচিত নয়।’
করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ডাক্তারদের আরও সতর্ক হতে হবে। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে রোগীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়। এছাড়া পরবর্তী সময়ে অনেক শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
সেমিনারে অংশ নিয়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘যে হারে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়েছে তা আগামী দিনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। করোনার সময়টাতে একজনকে দেয়া চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র আরো বেশ কিছু রোগী অনুসরণ করেছেন। এটাও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ আসছে। এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাজ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পাবো।’
সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন।