কুমিল্লায় অফিসে ঢুকে কাউন্সিলর সৈয়দ মো. সোহেলসহ দুজনকে গুলিতে ঝাঁজড়া করে দেয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ কারও নাম না জানালেও স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচিতজনদের সাম্প্রতিক বিরোধের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
শাহ আলম নামে ওই যুবকের বিরুদ্ধে এলাকায় সন্ত্রাস, খুনোখুনিতে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। একাধিক মামলাও আছে এসব ঘটনায়।
অবশ্য যে ধরনের বিরোধ, তাতে এত বড় একটি ঘটনা ঘটতে পারে কি না, এ নিয়েও আছে প্রশ্ন। যদিও স্থানীয়রা বারবার তার দিকেই আঙুল তুলছেন।
সোমবার বিকেলে সোহেলকে তার অফিসে ঢুকে গুলি করে হত্যার পর থেকে শাহ আলমকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তার স্বজনরাও নেই বাড়িতে। তারা কেন বাড়ি থেকে চলে গেছেন, এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে স্থানীয়দের মধ্যে।
পুলিশ এই ঘটনার তদন্তে শাহ আলমের অতীতের নানা ভূমিকাও নতুন করে খতিয়ে দেখার কথা বলছে।
এই হত্যায় শাহ আলমের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন কাউন্সিলর সোহেলের ঘনিষ্ঠ সহচর মো. হাবিবের ভাই মাহবুব আলম অপুও।
সরাসরি শাহ আলমের নাম না নিলেও হাবিব তার ভাইয়ের অভিযোগে সমর্থন দিয়েছেন।
এই হত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জমা পড়েনি।
ওসি আনওয়ারুল বলেন, মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এখনও কাউকে আটক করা হয়নি। তবে অভিযান চলছে।
শাহ আলমের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এলাকার ত্রাস শাহ আলম
কুমিল্লা নগরীর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা জানান, খুন, ছিনতাই, জমি দখলসহ নানা অপকর্মে শাহ আলমের নাম জড়িয়ে আছে।
কোতোয়ালি থানায় শাহ আলমের নামে হত্যাসহ এক ডজন মামলা আছে বলে জানিয়েছেন ওসি আনওয়ারুল আজিম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার অন্তত দশ ব্যক্তি নিউজবাংলাকে জানান, বছর দশেক আগে আধিপত্য বিস্তারের জেরে শাহ আলমের বাবা জানু মিয়াকে এক ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করেন। এ ঘটনার দিন দশেক পর শাহ আলম ওই ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন। ২০১৫ সালে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে শাহ আলমের পায়ে গুলি লাগে।
প্রচার আছে, শাহ আলম টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাস-মারামারি করতেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে যেসব খুনের অভিযোগ আছে, তার পেছনেও টাকার সংশ্লিষ্টতা আছে বলে প্রচার আছে।
তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে একসময় জড়িত ছিলেন বলেও এলাকায় চাউর আছে।
১৬ নম্বর ওয়ার্ডের শাহ আলমের নামে আছে একাধিক মামলা
তবে তার নামে যেসব মামলা আছে, সেগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেননি ওসি আনওয়ারুল। তিনি জানান, কাউন্সিলর হত্যার ঘটনায় মামলা হওয়ার পরই সব ধরনের তথ্য দেয়া যাবে।
কাউন্সিলরের সঙ্গে যা নিয়ে বিরোধ
পাথুরিয়া পাড়া ঈদগা মাঠে সোহেলের জানাজার আগে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় হাবিবের ভাই অপুর।
অপুর দাবি, এই হত্যা শাহ আলমের নির্দেশেই হয়েছে।
তিনি জানান, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক যুবকের সঙ্গে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নারীর বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক আছে। কিছুদিন আগে ওই নারীর সঙ্গে দেখা করতে গভীর রাতে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে যান ওই যুবক। তখন এলাকাবাসী তাকে চোর আখ্যা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এ বিষয়ে বন্ধু শাহ আলমের কাছে অভিযোগ দেন ওই যুবক।
অপু আরও জানান, এই বিষয়টি নিয়ে শাহ আলম ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সোহেলের অনুসারীদের সঙ্গে তর্কাতর্কিও হয়। সপ্তাহখানেক আগে এর জেরে দুই পক্ষের লোকজনের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এসব কারণে সোহেলের ওপর শাহ আলম ক্ষিপ্ত ছিলেন।
অপুর দাবি, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন যে শাহ আলমের নেতৃত্বেই সাতটি মোটরসাইকেলে করে দুবৃর্ত্তরা ঘটনাস্থলে গিয়ে সোহেল ও তার লোকজনের ওপর গুলি চালায়।
শাহ আলম কোথায়
এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে তার বাড়িতে গিয়ে তালা ঝুলতে দেখা যায়।
শাহ আলমের বাড়িতে তালা ঝুলছে, প্রতিবেশীরা জানে না কোথায় তিনি
প্রতিবেশীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সোহেলের হত্যার ঘটনার পর থেকেই এলাকায় দেখা যায়নি শাহ আলম বা তার পরিবারের কাউকে।
যেভাবে খুন হন সোহেল
নিজ কার্যালয়ে সোমবার বিকেল ৪টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন কাউন্সিলর সোহেলসহ অন্তত ৫ জন। তাদের কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সোমবার সন্ধ্যায় মারা যান কাউন্সিলর ও তার সঙ্গী হরিপদ সাহা।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আনওয়ারুল জানান, বিকেল ৪টার দিকে কাউন্সিলর সোহেল সুজানগরে তার কার্যালয়ে বসে ছিলেন। এ সময় মুখোশ পরা ১৫ থেকে ২০ জন তাকে গুলি করে। এতে সোহেল লুটিয়ে পড়েন।
এ সময় গুলিবিদ্ধ হন হরিপদ সাহা, পাথুরীয়াপাড়ার মো. রিজু ও মো. জুয়েল এবং সুজানগর এলাকার সোহেল চৌধুরী ও মাজেদুল।
স্থানীয়রা এগিয়ে এলে হামলাকারীরা গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ করতে করতে চলে যায়।
১৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ মিয়া জানান, নেতা-কর্মীদের নিয়ে কাউন্সিলর সোহেল তার কার্যালয়ে বসে ছিলেন। মোটরসাইকেলে এসে কয়েকজন সন্ত্রাসী অতর্কিত গুলি চালায়।
হামলায় আহত জুয়েল বলেন, ‘আওয়াজ শুনে রাস্তায় বের হয়ে দেখি, সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছে। এ সময় আমার পায়ে গুলি লাগে। তারপর কী হয়েছে বলতে পারছি না।’
কাউন্সিলর সোহেলের ভাগনে মোহাম্মদ হানিফ জানান, ‘সবাই আসরের নামাজ পড়ছিলেন। এ সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ কানে আসে। গিয়ে দেখি মামা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। আমি নিজে মামাকে কাঁধে করে বের করি।’