বিদেশি ঋণে স্বস্তিতে রয়েছে সরকার। গত দুই অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ সহায়তা পাচ্ছে সরকার। এতে করোনা মহামারিকালেও সরকারকে অর্থ সংকটে পড়তে হয়নি; ব্যাংক থেকে খুব একটা ঋণ নিতে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের অনুকূলে ১৯৪ কোটি (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার অর্থ ছাড় করেছে দাতারা। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১৪০ কোটি ডলারের (১.৪ বিলিয়ন) ছাড় করেছিল দাতারা। এ হিসাবে এই তিন মাসে দেশি-বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো।
সংকটের সময়ে বেশি ঋণ পেয়ে খুশি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি ঋণ সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এতে করোনার টিকা খাতে ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ মেটাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে দ্রুত ঋণ সহায়তা পাওয়া গেছে। আমরা (সরকার) আমাদের প্রয়োজনের বিষয়টি তাদের ভালোভাবে উপস্থাপন করেছিলাম। তারা দ্রুত সাড়া দিয়েছেন; এখনও দিচ্ছেন। সে কারণে করোনার ধাক্কা সামলে খুব দ্রুতই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি; যা বিশ্বের অনেক দেশই পারেনি।’
বিদেশি ঋণের এই গতি আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, এই মহামারিকালে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণ সহায়তা পেয়েছি আমরা। চলমান প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি করোনা মোকাবিলার জন্যও মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়া গেছে। এখনও পাওয়া যাচ্ছে; ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
‘আমরা আমাদের প্রয়োজনের কথা সঠিকভাবে দাতাদের কাছে উপস্থাপন করেছিলাম। সে কারণেই তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আর এই ঋণ সহায়তা এবং আমাদের সরকারের ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব যতটা পড়ার কথা ছিল, ততটা পড়েনি।
‘সব মিলিয়ে বর্তমান পেক্ষাপটে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, করোনা মহামারি আমরা ভালোভাবেই মোকাবিলা করে চলেছি। মাঝে টিকা নিয়ে একটু সমস্যা থাকলেও এখন আর নেই। প্রচুর টিকা আছে; আরও আসছে। টিকার আর কোনো সংকট হবে না। আর টিকা কিনতে অর্থেরও কোনো সমস্যা হবে না।’
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণ কোভিড মোকাবিলায় সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে। পর পর দুই বছর ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফরেন এইড অবাক করার মতো; চলতি অর্থবছরেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। এই কঠিন সময়েও সরকারকে কোনো ধরনের অর্থ সংকটে পড়তে হয়নি। উন্নয়নকাজ থেমে থাকেনি; টিকা কিনতে সমস্যা হয়নি।’
‘আর এসব কারণেই কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা ছাড়া কিন্তু অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই চলছে' বলেন দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর।
এই অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো যে বিদেশি ঋণ এসেছে, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি ১০৬ কোটি ৬৩ লাখ ডলার দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ২১ কোটি ২৪ লাখ ডলার।
জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা ছাড় করেছে ১৮ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। চীন দিয়েছে ২২ কোটি ৪১ লাখ ডলার। ভারতের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৩ কোটি ডলারের কিছু বেশি। রাশিয়া দিয়েছে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ছাড় করেছে ৪০ হাজার ডলার। এ ছাড়া অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ১৬ কোটি ডলার ঋণৱ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
তিন বছর আগেও বিদেশি ঋণ ছাড় হয়েছিল ৩০০ কোটি ডলারের মতো। করোনার মধ্যে সেটি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭১০ কোটি (৭.১ বিলিয়ন) ডলার ঋণ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ আসে বাংলাদেশে। ওই বছর ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল।
গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ঋণ পাওয়া গেছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। সংস্থাটি ২৭০ কোটি ডলার ছাড় করেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছাড় করেছে এডিবি ১৭০ কোটি ডলার।
তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এই তিন মাসে বিশ্বব্যাংকের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি অর্থ ছাড় করেছে এডিবি।
গত ছয় অর্থবছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ ছাড়ের প্রবণতা বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছিল ৬৫৪ কোটি ডলার। তবে গত দুই বছর টানা ৭০০ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পাওয়া গেছে। করোনা মহামারি থেকে উত্তরণে টিকাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্যান্য সহযোগী সংস্থা বাড়তি ঋণ দিচ্ছে।