বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দিয়ে মোবাইল বিক্রির কথা বলে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিনব কায়দায় গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জন করে প্রতারণা করতেন তারা। গ্রেপ্তারকৃত তিন প্রতারক হলেন- সোজায়েত আহমেদ শিখন, আল-আমিন ও শাহিনুর রহমান বিপ্লব।
রোববার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) জোনায়েদ আলম সরকার ঘটনাটি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ‘আল-আমিন প্রতারণার জন্য ৩৫০ টাকা করে ভুয়া নিবন্ধনের সিম কিনতো বিভিন্ন কোম্পানির ভাসমান বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। এসব বিক্রয় প্রতিনিধি সাধারণ মানুষের সিম নিবন্ধনের সময় বিভিন্ন কৌশলে তাদের অগোচরে দুই বা ততোধিক সিম নিবন্ধন করে ফেলে। পরে এই সিমগুলো বেশি দামে আল-আমিনের মতো ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে।’
তিনি জানান, আল-আমিন ভুয়া নিবন্ধনের সিম শিখন ও বিপ্লবের কাছে ৫০০ টাকা করে বিক্রি করতেন। এ ছাড়া কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের একেকটি বুকিং বই ৩৫ হাজার টাকা করে কিনতেন তিনি। এই বই পরে শিখন ও বিপ্লবের কাছে ৩৮ হাজার টাকা করে বিক্রি করতেন।
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) জোনায়েদ আলম সরকার বলেন, ‘প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতারণার কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন কৌশলে তিন-চারজন পুলিশ সদস্যের আইডি কার্ডও সংগ্রহ করেছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন অনলাইন ওয়েবসাইট ও অ্যাপস দিয়ে এনআইডিও তৈরি করতো তারা। পরে ভুয়া নিবন্ধনের সিম দিয়ে জিমেইল অ্যাকাউন্ট খুলে এগুলো দিয়ে তারা বিক্রয় ডটকমেও অ্যাকাউন্ট খুলতো।
এসব অ্যাকাউন্টে প্রতারণার উদ্দেশে মোবাইল বিক্রির পোস্ট দিত চক্রটি। আর যোগাযোগের জন্য তারা ভুয়া নিবন্ধনের সিমগুলোই ব্যবহার করতেন। তাদের পোস্টের বেশি প্রচার ও দ্রুত বিক্রির জন্য বিক্রয় ডটকমের টপ বিজ্ঞাপন বাবদ পোস্ট প্রতি ২০৯ টাকা ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে বিক্রয় ডটকমকে দিতেন তারা। এর ফলে প্রতারকরা দ্রুত মোবাইল কিনতে চাওয়া ক্রেতাদের সাড়া পেতেন।
যেভাবে প্রতারণা করত চক্রটি
ক্রেতারা প্রতারকদের পোস্টের ইনবক্সে মোবাইল কেনার আগ্রহ দেখালে, বিস্তারিত যোগাযোগের জন্য ভুয়া নিবন্ধনের সিম নম্বর দেয়া ছাড়াও ইমোতে যোগাযোগ করতে বলত চক্রটি। ইমোতে যোগাযোগ করলে ভিডিও কলের মাধ্যমে তারা বিক্রয় ডটকমে পোস্ট দেয়া মোবাইলটি দেখাতেন। পরে ক্রেতারা মোবাইল কেনার আগ্রহ দেখালে মোবাইল হস্তান্তরের মাধ্যম হিসাবে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস এবং টাকা লেনদেনের জন্য ই-ট্রানজেকশন ব্যবহারের কথা বলা হতো।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মোবাইল পাঠানোর পূর্বে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে মোবাইলের দামের ৫০ শতাংশ টাকা অগ্রিম এবং বাকি টাকা মোবাইল পাঠানোর জন্য সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে বুকিং দিয়ে স্লিপ দেখানোর পর পরিশোধ করতে হবে বলে জানাতেন চক্রের সদস্যরা।
এ ক্ষেত্রে ক্রেতা অগ্রিম টাকা পাঠানোর প্রস্তাবে রাজি না হলে তার বিশ্বাস অর্জনের জন্য ভুয়া আইডি কার্ড দেখিয়ে নিজেকে পুলিশও দাবি করতেন তারা। ইমো ইনবক্সে তারা পুলিশের আইডি কার্ড এবং এনআইডির ছবি দিতেন।
বিশ্বাস করে ক্রেতারা মোবাইল দামের ৫০ শতাংশ টাকা ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে অগ্রিম দিয়ে দিতেন। বাকি টাকা আত্মসাৎ করার জন্য তারা আগেই সংগ্রহ করে রাখা সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের বুকিং বইয়ে ক্রেতাদের দেয়া নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ইত্যাদি লিখতেন।
ক্রেতাদের আরও বিশ্বাস অর্জনের জন্য ভুয়া নিবন্ধনের সিম থেকে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি সেজে প্রতারক চক্রের সদস্যই কথা বলতেন। পরে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের সিল মোহরযুক্ত বুকিং স্লিপের ছবি তারা ক্রেতাদের ইমোতে পাঠাতেন এবং ক্রেতারা বুকিং স্লিপে দেয়া নাম্বারে কল করে তারা বুকিং বিষয়ে আবারও নিশ্চিত হতেন। নিশ্চিত হওয়ার পর মোবাইল ফোনের টাকা বাবদ বাকি ৫০ শতাংশ টাকা ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে পাঠাতেন। পুরো টাকা পাবার পরই ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতেন প্রতারকরা।
ভুক্তভোগীরা একের অধিক রিপোর্ট করলে বিক্রয় ডটকম সাধারণত পোস্টগুলো ডিলিট করে দেয়। অনেক সময় প্রতারকরাই সফল অপারেশনের পর পোস্টটি বিক্রয় ডটকম থেকে মুছে ফেলতেন।
সম্প্রতি এক ভুক্তভোগী এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তভার সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের কাছে আসার পর তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতারক চক্রের সঙ্গে সংম্পৃক্ত তিনজনকে শুক্রবার ময়মনসিংহ মুক্তাগাছা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।