ছেলের পক্ষ নিয়ে নিজের ভাই আব্দুল বাতেনের সমর্থকদের পিষে ফেলার হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংসদ শামসুল হক টুকুর বিরুদ্ধে। প্রমাণ হিসেবে এ ঘটনার ভিডিও ক্লিপ গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
পাবনার বেড়া পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন টুকুর ছেলে আসিফ শামস রঞ্জন। অন্যদিকে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন টুকুর ছোট ভাই ও বর্তমান মেয়র আব্দুল বাতেন।
এদিকে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় সাংসদ টুকুকে নির্বাচনি এলাকা ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ১৪ নভেম্বর চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
তবে অভিযোগ উঠেছে, অসুস্থতার অজুহাতে এলাকা না ছেড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রকাশ্যে ভোটারদের হুমকি দিচ্ছেন টুকু। স্থানীয় প্রশাসন ও থানার পুলিশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, শুক্রবার প্রাতর্ভ্রমণে গিয়ে বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা গ্রামে নারিকেলগাছ প্রতীকের প্রার্থী আব্দুল বাতেনের কর্মী ইয়ামিনসহ কয়েকজন যুবকের সঙ্গে দেখা হয় সাংসদ টুকুর। এ সময় আব্দুল বাতেনের পক্ষে ভোট করায় তাদের হুমকি-ধমকি দেন। এ সময় সাংসদ টুকুর সঙ্গে ইয়ামিনের পুরো কথোপকথনের ভিডিও গোপনে ধারণ করেন ইয়ামিনের এক বন্ধু।
ভিডিওতে দেখা যায়, ইয়ামিন কেন নারিকেলগাছের নির্বাচন করছে জানতে চেয়ে ধমক দিচ্ছেন সাংসদ টুকু।
সাংসদ টুকু বলেন, ‘ওখানে যাবি না। তোগোরে পুলিশ দিয়ে মারতেও আমার ভয় লাগে, খারাপ লাগে। যে কয়টাকে মারবনে, চার-পাঁচটাকে...একটা আমিনুল, দেহিসনে কী অয়।’
আব্দুল বাতেনের নির্বাচনি ক্যাম্পে না যেতে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যাবি, না যাবি না? আজকে নৌকার মিছিল করবি। নৌকা হলো জাতির প্রতীক। আর ওই শালা খেজুরগাছ সেদিন ছিল আউয়াল, আজ হলো বাতেন (এ সময়ে পাশ থেকে একজন বলেন, খেজুরগাছ নয়, নারিকেলগাছ)। আমি কিন্তু মায়াদয়া করবনানে, পিষে ফ্যালবনে।’
হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়ামিন বলেন, ‘আমি শুক্রবারই পরিবারসহ এলাকা ছেড়ে চলে এসেছি। ঘটনার পর ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন আমিনুলও।’
আমিনুলের স্ত্রী শিউলি বেগম বলেন, ‘সাংসদ টুকু ও তার ছেলে রঞ্জনের সন্ত্রাসী বাহিনী আমার স্বামীকে হত্যার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। গভীর রাতে পুলিশ এসে তার খোঁজ করে না পেয়ে বাড়িতে ভাঙচুর করেছে। ভয়ে-আতঙ্কে শিশুসন্তানকে আমার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার স্বামী কোথায় আছে কিছুই জানি না।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল বাতেন বলেন, ‘নিজ পুত্রকে মেয়র বানিয়ে পৌরসভার দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন এমপি সাহেব। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভয় দেখিয়েও মানুষকে আটকে রাখতে না পেরে তিনি নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে সারা জীবন জেলে আটকে রাখা, পিটিয়ে এলাকাছাড়া করাসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘এলাকায় জনসমর্থন না পেয়ে সাংসদ টুকু ও তার ছেলে বহিরাগত ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের এনে এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে। আমার কর্মী ও সমর্থকদের এলাকাছাড়া করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের চিঠি পেয়েও এলাকা না ছেড়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে মিথ্যা মামলায় আমার কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি প্রতিটি ঘটনার প্রমাণসহ নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি। আশা করছি, নির্বাচনের নিরপেক্ষ সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেবে।’
স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী সাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রধান অন্তরায় সাংসদ শামসুল হক টুকুর এলাকায় অবস্থান। তিনি কেবল সংসদ সদস্যই নন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তার কথা অমান্য করা পুলিশের জন্যও কঠিন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, নৌকায় ভোট না দিলে এলাকা শ্মশান বানিয়ে দেবেন।’
আরেক স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী এইচ এম ফজলুর রহমান মাসুদ বলেন, ‘সাংসদ টুকু সাহেব নির্লজ্জের মতো আচরণ করছেন। রাস্তায় বেরোলেই আমার কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। পুলিশ আমাদের অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে এমপি সাহেবের কর্মীর মতো আচরণ করছে।’
এলাকা ত্যাগের অনুরোধসহ সাংসদ টুকুকে নির্বাচন কমিশনের দেয়া চিঠিতে বলা হয়, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচনি এলাকায় প্রচারণা বা নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। বেড়া পৌরসভা সাধারণ নির্বাচন প্রভাবমুক্তভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তথা মাননীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান না করার জন্য আপনাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করা হলো।
তবে নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের চিঠি পাওয়ার পর ১৫ নভেম্বর সাংসদ টুকু বৃশালিখা পল্টন সমাজের আয়োজনে এক দোয়া অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভায় অংশ নেন। রোববার সন্ধ্যায়ও মোহনগঞ্জ এলাকায় নির্বাচনি সভায় অংশ নেন। এসব সভায় নৌকার প্রার্থীর পক্ষে ভোটও চাওয়া হয়।
এসব ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ পেয়েছেন জানিয়ে জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছি। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনি এলাকায় অবস্থানের বিষয়ে সাংসদ শামসুল হক টুকু বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন আমাকে চিঠি দিয়ে বলেছে যে আমি যেন নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলি আর সম্ভব হলে যেন এলাকার বাইরে থাকি। কিন্তু আমি তো এলাকার মানুষ, আমি যাবটা কোথায়? আমি এখানকার ভোটার। আমি নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে কোনো কাজ করছি না।’
প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র পদপ্রার্থীর এক সমর্থককে পিষে মেরে ফেলার হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে শামসুল হক বলেন, ‘কাউকে হুমকি দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এগুলো মিথ্যাচার।’
পুলিশের ভয় দেখানোর প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, ‘আমাদের বিশাল কর্মী বাহিনীই আছে। পুলিশকে কেন ব্যবহার করব? পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করছে।’
বেড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরবিন্দ সরকার বলেন, ‘অকারণে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। এজাহার নামীয় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমরা আইন অনুযায়ী কাজ করছি। কে কী বলল তাতে আমাদের মাথাব্যথা নেই।’