সিলেট বিভাগে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে বিদ্রোহীদের থামাতে পারছে না আওয়ামী লীগ। তৃতীয় ধাপে বিভাগের ৭৭টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের অন্তত ৮০ জন দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
তৃতীয় ধাপে এসব ইউনিয়নে ভোট ২৮ নভেম্বর। বিদ্রোহী প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি লড়াইয়ে থাকায় আওয়ামী লীগ মনোনীতরা পড়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জে ।
এর আগে ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে সিলেটের ৪৩টি ইউনিয়নে ভোট হয়। বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে ৪৩ ইউনিয়নের মধ্যে ২৩টিতেই পরাজিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। বেশির ভাগ ইউনিয়নে বিদ্রোহীদের কারণে ভরাডুবি হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের।
পরের ধাপের নির্বাচনেও সিলেট বিভাগের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
সিলেট বিভাগের ৯ উপজেলার ৭৭ ইউনিয়নে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ হয়েছে। প্রতীক পেয়ে প্রচারে নেমেছেন তারা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সূত্র জানায়, এবারও ইউপি নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ না নিলেও স্বতন্ত্র হিসেবে বিএনপি নেতারা প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের পাশাপাশি বিএনপির (স্বতন্ত্র) প্রার্থীরাও চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন নৌকার প্রার্থীদের।
তবে বিদ্রোহীদের বসাতে এখনও চেষ্টা চলছে বলে জানান সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। এতেও যদি তারা প্রার্থিতা থেকে সরে না আসেন তবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় ধাপে সিলেট জেলার ১৬টি, সুনামগঞ্জের ১৭টি, হবিগঞ্জের ২১টি এবং মৌলভীবাজারের ২৩ ইউনিয়নে ভোট হবে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও সিলেটের জৈন্তাপুরে বিদ্রোহী কম থাকলেও অন্য উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি।
সিলেটের গোয়াইনঘাটে ৬ জন, জৈন্তাপুরে ২, দক্ষিণ সুরমায় ৫, সুনামগঞ্জ সদরে ১৪, শান্তিগঞ্জে ১২, হবিগঞ্জ সদরে ৮, নবীগঞ্জে ১৬, মৌলভীবাজারের বড়লেখায় ১৪ এবং কুলাউড়ায় আওয়ামী লীগের ৩ নেতা স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থী হয়েছেন।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাহ ওলিদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন বিদ্রোহী মুজিবুর রহমান। জালালপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ওয়েছ আহমদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন দলীয় নেতা নেছারুল হক চৌধুরী মোস্তান। লালাবাজার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তোয়াজিদুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী (বিদ্রোহী) হয়েছেন আব্দুল মুহিত। মোগলাবাজার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সদরুল ইসলাম। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ফখরুল ইসলাম শায়েস্তা। দাউদপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল হককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন দলের নেতা নুরুল ইসলাম আলম।
গোয়াইনঘাটের রুস্তমপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাসুক আহমদ। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী আব্দুল মতিন। ফতেহপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন বিদ্রোহী আমিনুর রহমান চৌধুরী। লেঙ্গুরা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মুজিবুর রহমান। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া রাসেল। নন্দীরগাঁও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরুল হাসান আমিরুল। তার সঙ্গে বিদ্রোহী হিসেবে মাঠে রয়েছেন সিরাজুল ইসলাম।
ডৌবাড়ি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুভাষ দাশের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম নিজাম উদ্দিন। তোয়াকুল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী লোকমান আহমদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন শামসুদ্দিন আহমদ।
সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার জৈন্তাপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুর রাজ্জাক রাজা। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম। চা-বাগান অধ্যুষিত চিকনাগুল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুর রশিদ প্রার্থী হয়েছেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনির উদ্দিন। দলীর প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন আব্দুছ সালাম। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকছুদ আলী। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন দলীয় নেতা আব্দুল কাদির। কোরবাননগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামস উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন দলীয় নেতা আফজাল নূর ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী কোহিনূর আলম।
মোহনপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সীতেশ রঞ্জন দাস তালুকদার। দলীয় নেতা মঈন উল হক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে আছেন। কাঠইর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বুরহান উদ্দিন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মাঠে আছেন দলীয় নেতা আজিজুর রহমান তালুকদার ও আব্দুল মতিন। সুরমা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস ছাত্তারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আমির হোসেন রেজা ও তাজুল ইসলাম। গৌরারং ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছালমা আক্তার চৌধুরী। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন দলীয় নেত্রী চম্পা বেগম এবং সারুয়ার আহমেদ।
শান্তিগঞ্জের শিমুলবাক ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মিজানুর রহমান জিতুকে চ্যালেঞ্জ করে ভোটে আছেন দলীয় আব্দুল্লাহ মিয়া ও শাহীনুর রহমান। জয়কলস ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত মাসুদ মিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছেন দলীয় নেতা আব্দুল বাছিত সুজন, হাছান মামুদ তারেক, রাজা মিয়া ও আব্দুল লতিফ কালা শাহ। পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জগলুল হায়দারের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন দলীয় নেতা বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল হক। পূর্ব পাগলা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী রাশিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন দলীয় নেতা কামাল হোসেন ও জয়নাল আবেদীন।
দরগাপাশা ইউনিয়নে দলের প্রার্থী মনির উদ্দিনের বিরুদ্ধে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন আওয়ামী লীগ নেতা মাছুদুল হাসান। পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী রিয়াজুল ইসলামের বিপরীতে ভোটে লড়ছেন আওয়ামী লীগ নেতা মসফিকুর রহমান ও রুবেল মিয়া। পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেবাংশু শেখর দাশের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দলীয় নেতা সফিকুল ইসলাম ও শামছুল আলম ভূঁইয়া। পাথারিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামছুল ইসলাম রাজাকে লড়তে হচ্ছে দলীয় নেতা শহীদুল ইসলাম ও হারুনুর রশীদ তালুকদারের সঙ্গে।
মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্ণি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী জোবায়ের হোসেনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা শামীম আহমদ এবং তাঁতী লীগ নেতা আব্দুল মুহিত। দাসেরবাজার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক মাহতাব উদ্দিন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার চক্রবর্তী।
উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রফিক উদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. আতাউর রহমান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. মুমিনুর রহমান টনি। দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত নাহিদ আহমদ বাবলুর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন।
বড়লেখা সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত সালেহ আহমদ জুয়েলের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সিরাজ উদ্দিন। তালিমপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত বিদুৎ কান্তি দাসের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান।
দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনাম উদ্দিনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মো. নজরুল ইসলাম, উপজেলা যুবলীগের সদস্য আব্দুল জলিল ফুলু, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশাহিদ আহমদ ও ইউনিয়ন তাঁতী লীগের আহ্বায়ক আশরাফ হোসেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন তাঁতী লীগের আহ্বায়ক আশরাফ হোসেন কয়েক বছর আগে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত সুলতানা কোহিনুর সারোয়ারীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আজির উদ্দিন।
হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্রোহীদের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য কেন্দ্রের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। কেন্দ্রের নির্দেশ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন বলেন, ‘দলের মনোনীত প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে যারা ভোটে লড়ছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।