বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টাকার দরপতনে বিদেশি ঋণধারীদের মাথায় হাত

  •    
  • ২১ নভেম্বর, ২০২১ ০৮:১৬

ফলে পাঁচ বছর আগে যারা বিদেশ থেকে ঋণ এনেছেন, তাদের বিনিময় হারের কারণে ১০ শতাংশ বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে সুদহার কম হলেও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে দেশি উৎসের ঋণে যে অর্থ পরিশোধ করতে হতো, তার চেয়ে বেশি খরচ হবে এখন।

কম সুদের বলে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা ব্যবসায়ীরা ডলারের দর বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন। ফলে দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ-আসলে যে টাকা পরিশোধ করতে হতো, এখন তাদের পরিশোধ করতে হবে তার চেয়ে বেশি।

দেশে বাড়ছে শিল্প উৎপাদন। উন্মোচন করা হচ্ছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থায়ন এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থায়নের জন্য দেশি উৎসের পাশাপাশি এখন বেশিসংখ্যক উদ্যোক্তা বিদেশি ঋণে ঝুঁকছেন।

বলা হচ্ছে দেশের তুলনায়, বিদেশি ঋণে সুদহার কম। তবে ঋণের অর্থ ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রায় দেশে আসে আর তা পরিশোধও করতে হয় বিদেশি সেই মুদ্রায়। এ কারণে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার যদি বেড়ে যায়, তাহলে ঋণগ্রহীতাদের বেশি দামে তা কিনতে হবে। ফলে তাদের প্রত্যাশিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হতে পারে।

এই ঘটনাটিই ঘটছে সম্প্রতি। টানা কয়েক বছর টাকার সঙ্গে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলেও এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। ডলারের দর হঠাৎ করেই এখন চড়া। আন্তব্যাংকে প্রতি ডলার বিনিময় হার এখন ৮৫.৮০ টাকা। তবে বছর কয়েক আগেও ছিল ৭৬ থেকে ৭৭ টাকা।

ফলে সে সময় যারা ঋণ নিয়েছেন ঋণগ্রহীতাদের প্রত্যাশিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে।

পাঁচ বছর আগেও ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৭৬ টাকা ৬০ পয়সাতেও ডলার কিনতে পারা গেছে। প্রায় তিন বছর ঘুরে-ফিরে একই দর ছিল। তবে সে সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশের বেশি মূল্য হারায় টাকা।

ফলে ৫ বছর আগে যারা বিদেশ থেকে ঋণ এনেছেন, তাদের বিনিময় হারের কারণে ১০ শতাংশ বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে সুদহার।

আবার ঋণ দেশে ডলারে এলেও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশি মুদ্রাতেই তা পান উদ্যোক্তারা। এখানেও ডলারপ্রতি ২০ থেকে ৩০ পয়সা কমিশন কেটে রাখা হয়। আবার ঋণ পরিশোধে ডলার কেনার সময়ও অতিরিক্ত ২০ থেকে ৩০ পয়সা বেশিতে কিনতে হয়।

বছর পাঁচেক আগেও বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ১২ শতাংশের বেশি থাকায় বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও বিদেশি ঋণে ঝুঁকতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।

তবে এখন দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ভালো ঋণদাতা ও বড় অঙ্ক হলে এর চেয়ে কম সুদেও ঋণ দেয়া হচ্ছে।

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণে উদ্যোক্তাদের লাভ কমে যাবে। ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো বিদেশি ঋণ আকর্ষণীয় থাকবে না। কারণ ঋণ ডলারে শোধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাপ দিয়ে ব্যাংকব্যবস্থায় ডলারের দর স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাজার থেকে (কাব মার্কেট) ডলার কিনতে হলে চড়া দাম দিতে হবে। আবার সব সময় পাওয়াও যাবে না।’

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণ অনেক হিসাব-নিকাশ করে দেয়া হয়। আমরা চেষ্টা করি যত কম এ ঋণ দেয়া যায়। দেশি ঋণ নিতে হলে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে, কিন্তু বিদেশি ঋণ ৩ বা ৪ শতাংশে পাওয়া যাচ্ছে।

‘তবে বিদেশি ঋণে যে সব সময়ই লাভ হবে, এমন নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিও হয়। বর্তমানে ডলারের দর ঊর্ধ্বমুখী। ডলারের দাম যদি বাড়তে থাকে তাহলে বিদেশি ঋণ উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষতির কারণ। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে পড়বে।’

বর্তমানে দেশীয় ঋণের চাহিদাও বেড়েছে বলে জানান এই ব্যাংকার। বলেন, ‘করোনার কারণে ঋণের চাহিদা কম ছিল। তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে করপোরেট ঋণ ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন ঋণের চাহিদা বেড়েছে। ফলে ৯ শতাংশের কম সুদে ঋণে এখন ঋণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট শামস মাহমুদ বলেন, ‘মুদ্রার বিনিময় হার যেকোনো সময় বেড়ে যেতে পারে, এই বিষয়টি তাদের মাথায় থাকে। এ কারণে এসব ‍ঋণ তারা দ্রুত পরিশোধ করার চেষ্টা করেন। তবে ডলারের দর এখন কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বেচাকেনা করে নিয়ন্ত্রণ করছে।’

কবে থেকে এই সুযোগ

বিদেশ থেকে দেশি উদ্যোক্তাদের ঋণ সংগ্রহের সুযোগ প্রায় চার দশক আগেই করে দেয়া হয়েছে।

১৯৮৫ সালে ‘অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট’ নামে ব্যাংকের আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়। বর্তমানে ৩৬টি ব্যাংক এই বিভাগ গঠন করে ঋণ বিতরণ করছে।

প্রথম দিকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা নিলেও পরে অন্য খাতের উদ্যোক্তারাও এই সুবিধা নিতে শুরু করেন।

চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি বিদেশি ঋণ নেবার পথ আরও প্রশস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে বিদেশি মালিকানাধীন সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানও মূল কোম্পানি (প্যারেন্ট) থেকে ঋণ নিতে পারবে। তবে এ সুবিধা ট্রেডিং ব্যবসার জন্য প্রযোজ্য হবে না। উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রম শুরু থেকে ছয় বছর পর্যন্ত এ সুবিধা নেয়া যাবে। আগে এ সুবিধা তিন বছর পর্যন্ত নেয়া যেত।

মোট বিদেশি ঋণ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে ব্যক্তি বা বেসরকারি পর্যায়ে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা।

২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ঋণ ছিল ৬৩ হাজার দুই কোটি টাকা।

অর্থাৎ ছয় মাসে ঋণ ১০ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা বেড়েছে।

২০১৯ সালের শেষের দিকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে নেমে আসার পরই মূলত বিদেশি ঋণের প্রতি ঝোঁক কমতে শুরু করে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ ঋণ ছিল ৬০ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। পরের বছরের জুন পর্যন্ত ঋণ বেড়ে হয় ৬৩ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা।

অর্থাৎ সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হওয়ার পর বিদেশি ঋণ বাড়ার বদলে কমেছে।

বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতের নেয়া ঋণের মধ্যে সাড়ে ২১ শতাংশই হলো বাণিজ্যিক ঋণ। বাকি ঋণের মধ্যে আছে বহুপাক্ষিক, দ্বিপাক্ষিক ও সরবরাহকারী ঋণ।

ঋণে ঝুঁকিও আছে

বিদেশি ঋণ নিয়ে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। শিরোনাম ছিল ‘প্রসপেক্টাস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অফ শর্ট টার্ম ফরেন কারেন্সি ফিন্যান্সিং অব ব্যাংকস’।

এতে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান এ ঋণ বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

গবেষণা অনুযায়ী বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের বড় উৎসে পরিণত হয়েছে জার্মানি। দেশে আসা মোট ঋণের প্রায় ১৪ ভাগ ঋণই আসছে দেশটি থেকে।

লাইবর (লন্ডনের শীর্ষ ১৫ ব্যাংকের আন্ত লেনদেনে সুদহার) রেটের সঙ্গে ৩ ও ৩ দশমিক ৯ শতাংশ সুদে এসব ঋণ নেয়া হয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউরো ও বাংলাদেশি ব্যাংকের সুদহারে নেয়া হয়েছে। এখন লাইবর রেট বৃদ্ধি ও টাকার বিপরীতে ডলারের দর বৃদ্ধিতে এসব ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হতে পারে।

ঋণ যেভাবে নেয়া যায়

বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে বড় জোগানদাতা বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলো।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। অন্যদিকে দেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষপর্যায়ে রয়েছে ইস্টার্ন, সিটি, ব্র্যাক, এবি ও ইসলামী ব্যাংক।

অগ্রণী, আল-আরাফাহ, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা, ডাচ্‌-বাংলা, এক্সিম, আইএফআইসি, যমুনা, মার্কেন্টাইল, মিডল্যান্ড, মধুমতি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, এনসিসি, ওয়ান, প্রিমিয়ার, প্রাইম, পূবালী, শাহজালাল, সোশ্যাল ইসলামী, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট, ইউসিবি, উত্তরা, সিটি এনএ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ সিলন, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ও উরি ব্যাংকের মাধ্যমেও এ ঋণ দেয়া হয়।

হঠাৎ চড়া ডলার দর

অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার। বিশেষ করে ডলারের দর হঠাৎ তেজিভাব দেখা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৬ নভেম্বর আন্তব্যাংক বিনিময় হার ছিল প্রতি ডলার ৮৫.৮০ টাকা। অথচ ছয় মাস আগেও ১৬ জুনে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৪.৮০ টাকা। ছয় মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার ১ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।

এমন অবস্থায় টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে নভেম্বরের মাত্র ১৬ দিনেই ৩২৩ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ২০৫ মিলিয়ন ডলার কিনেছিল।

ডলার বিক্রির কারণে অক্টোবরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

বাজারে নগদ ডলারের চাহিদা বেশি হওয়ায় কার্ব মার্কেটেও ডলারের দাম বেড়েছে। এক বছর আগে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ব্যাংক রেটের কাছাকাছি ছিল। অর্থাৎ ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৯০ পয়সা। এখন তা বেড়ে গড়ে ৯২ থেকে ৯৩ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছরে এর দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।

টাকার দরপতন যদি না থামে, তাহলে বিদেশি ঋণদাতাদের আরও বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে ভবিষ্যতে।

এ বিভাগের আরো খবর