কয়েক বছর আগে যে কেউ ভাবির মোড় নামটি শুনলে চমকে উঠতেন। তবে এই নাম শুনলে এখন আর কেউ চমকে ওঠেন না। কারণ এই ভাবির মোড় বর্তমানে দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ভোজনরসিকদের কাছে জনপ্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এখানে হাঁসের মাংস দিয়ে যে কেউ একবার ভাত খেলে তাকে আবারও ফিরে আসতেই হবে।
বোচাগঞ্জ উপজেলার ছাতইল ইউনিয়নের টাঙন নদীর তীরে রাণীর ঘাট এলাকায় ভাবির মোড়ের অবস্থান। তবে কয়েক বছর আগে ভাবির মোড় নামে কেউ কোনো জায়গা চিনত না। তবে রাণীরঘাট নামক এলাকায় সাধারণ মানুষ সবাই চিনতেন।
বর্তমানে রাণীর ঘাটের বদলে ভাবির মোড় মানুষ বেশি চেনে। ভাবির মোড় নামকরণের পেছনে রয়েছে কয়েকজন গৃহবধূর গল্প। এই ভাবির মোড়ে প্রথমে এক গৃহবধূ হাঁসের মাংস আর ভাত বিক্রি শুরু করেন। এরপর একে একে পাশাপাশি গড়ে উঠে আরও চার গৃহবধূর খাবারের দোকান। এগুলো পরিচিত হতে থাকে ভাবির হোটেল নামে। আর জায়গাটির নাম হয় ভাবির মোড়।
ভাবির মোড়ের হাঁসের মাংস আর ভাত খেতে শুধু দিনাজপুরই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছেন ভোজনরসিকরা।
১৯৯০ সালের দিকে দিনাজপুর শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার আগে টাঙন নদী আরও প্রসারিত ছিল। শুষ্ক মৌসুমে নদী থেকে ট্রাকে করে বালু তোলা হতো। রাণীর ঘাট তখন জনশূন্য। প্রতিদিন ৭০-৮০টি ট্রাকে বালু যায় রাণীর ঘাট থেকে বিভিন্ন জেলায়। ট্রাকে বালু লোড করত শ্রমিকরা।
তাদের দরকার পড়ে কাজের ফাঁকে একটু চা-নাশতা করার। তাদের কথা শুনে ওই মোড়েই প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে তপ্ত রোদের মধ্যে চা-বিস্কুট বিক্রি শুরু করেন মাসতারা বেগম নামের এক গৃহিণী। ঘাটের পাশের পাঁচতারা গ্রামের বাসিন্দা জামালউদ্দিন। একদিন শ্রমিকদের অনুরোধেই সেখানে ডাল-ভাত-ডিম বিক্রি শুরু করেন। এর কিছুদিন পর শুরু করেন হাঁসের মাংস ও ভাত বিক্রি।
ক্রেতাদের দেয়া হয় মরিচ ও পেয়াজের সালাদ। এরপর একে একে বর্তমানে হোটেলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ। গত দুই বছর আগে ওই বালুর ঘাটে বালু তোলা বন্ধ করে প্রশাসন। তবে থেকে গেছে পাঁচ ভাবির হোটেল। এভাবে ধীরে ধীরে রাণীর ঘাট নাম বদলে হয়েছে ভাবির মোড়।
বর্তমানে ভাবির মোড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত টাঙন নদীর ওপরে নির্মিত হয়েছে সেতুসহ রাবার ড্যাম। নদীর পশ্চিমে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের ইন্দ্রল মোল্লাপাড়া। পূর্বে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার রাণীর ঘাট পরমেশ্বরপুর। দিনাজপুরসহ পাশের জেলা শহর থেকেও মানুষ শখের খাবার খেতে আসছেন এখানে। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে তুলনামূলকভাবে ভিড় বেশি হয়।
রাস্তার উভয়পাশে পাঁচটি ভাতের হোটেল। হোটেলের ভেতরে ওয়ালে লেখা ভাবির হোটেল। দেয়ালে বিভিন্ন ফুলের নকশাও আঁকা হয়েছে। টেবিলে রাখা গামলা ভর্তি হাঁসের মাংস। নিরিবিলি পরিবেশে ভোজন রসিকরা আসছেন, হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রেখেছেন। কেউ পার্সেল করে নিয়ে যাচ্ছেন।
এখানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন মাসতারা বেগম, তাসলিমা আক্তার, মেরিনা পারভীন, বেলী আক্তার ও নছিরা খাতুন।
বীরগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা নাঈম ইসলাম বলেন, ‘আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে এখানে এসেছি। বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরে এখানে হাঁসের মাংস খেতে আসছি। এখানকার হাঁসের মাংস খেয়ে আমার খুবই ভালো লেগেছে। এখানকার হাঁসের মাংস খুবই সুস্বাদু।’
দিনাজপুর শহর থেকে আসা শামিমা আক্তার আশা বলেন, ‘শহরের আশপাশে যে হোটেলগুলো আছে, সেগুলোতে ভাবির মোড়ের মতো রান্না হয় না। ভাবির মোড়ে শহর থেকে আসতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায়। এতে একটু বিনোদনও হয়।’ তিনি বলেন, ‘এখানে আসতে আসতে আমি গ্রামের পরিবেশ দেখতে পেলাম। আসলে ভাবির মোড়ের হাঁসের মাংস অনেক সুস্বাদু। আমি আমার বন্ধুদেরও এখানে আসার পরামর্শ দেব।’
ভাবির মোড়ের হোটেল ব্যবসায়ী তাসলিমা খাতুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখানে ২০০০ সালে দোকান দিছি। তখন এখানে বালুর ঘাট ছিল। এখানকার শ্রমিকরা আমার কাছে এসে ভাত খাবে বলে জানায় এবং আমাকে ভাত ও তরকারি রান্না করার জন্য বলে। এরপর হাঁসের মাংস রান্না করতে থাকি। প্রচারের কারণে এখন আমাকে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি হাঁস জবাই করতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন ঈদ ও পূজার সময় আমাদের অনেক হাঁস বিক্রি হয়। ঈদ ও পূজার সময় আমাদের ৫০ হাজার টাকার বিক্রি হয়।’
হোটেল ব্যবসায়ী বেলী আক্তার বলেন, ‘ঘাট বন্ধ হওয়ার পরে ব্যবসায় কিছুদিন মন্দা গেছে। পরে রাস্তা পাকার কাজ শুরু হলে আবার বেচাবিক্রি শুরু হয়। আর এখন এমন পরিচিতি হইছে, দূর থাকি মানুষ এখানে খাবার খাইতে আসে। স্বামী নিজের পেশা বদল করে আমার হোটেলে সময় দেয়। এই ব্যবসা করে নিজের স্বামীকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দিছি।’
তিনি বলেন, ‘সে মোটরসাইকেল নিয়ে রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ, পীরগঞ্জ, সেতাবগঞ্জ, কাহারোলসহ বিভিন্ন হাট থেকে হাঁস কিনে আনে। অনেক সময় আশপাশের হাঁসের ফার্ম থেকেও হাঁস আনতে হয়।’
সর্বশেষ হাঁসের মাংসের হোটেল দিয়েছেন নছিরা খাতুন।
তিনি বলেন, ‘এখানে হাঁসের মাংস খেতে আসা মানুষের অনেক ভিড় থাকে। অনেকে হোটেলগুলোতে ভিড় দেখে চলে যায়। তাই আমিও দোকান দিয়েছি। আমার দোকানেও অনেক কাস্টমার আসে।’
ছাতইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাত্র কয়েকজন গৃহবধূর কারণে রানীরঘাট এলাকার নামটি ভাবির মোড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটা আমার ইউনিয়নবাসীর জন্য গৌরব। কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ভাবির মোড়ে হাঁসের মাংস খেতে বহু দূর থেকে মানুষ আসে।’