পুরুষকে ঘিরে যে কঠোর, অনমনীয় ও নিরাবেগ ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে, সেটির আড়ালে চাপা পড়ে যায় একজন পুরুষের হৃদয়ের অনেক হাহাকার। ফলে পুরুষও যে গোপনে ভাঙে, গোপনে কাঁদে তার প্রায় সবটিই থেকে যায় অজানা।
নারীর প্রতি দৃশ্যত কঠোর পুরুষও হয় বিরহকাতর। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মেলে দিয়েছেন সেই যাতনার ঝাঁপি। প্রেয়সীকে তিনি লেখেন, ‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত; কী অসীম বেদনা।’
জীবনশাস্ত্র, সংসার, বেঁচে থাকার লড়াই পুরুষকে করে তুলছে নাজুক। পরিসংখ্যানও অবশ্য সেই নাজুক পরিস্থিতির স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। ন্যাশনাল টুডে ডটকম শুধু যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য তুলে ধরে বলছে, বিনিদ্র রজনী যারা পার করছেন কিংবা বার বার ঘুম ভেঙে ছটফট করছেন তাদের ৮৭ শতাংশ পুরুষ। নিখোঁজ মানুষের যে সংখ্যা, সেই নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, তাদের ৭৩ শতাংশ পুরুষ।
জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যারা হচ্ছেন আত্মঘাতী, তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ পুরুষ। উচ্চ কোলেস্টেরলেও পুরুষের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তের হার ২৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে গেল বছর ২২ শতাংশ পুরুষ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানা সমস্যায় পড়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন।
তাই আজকের দিনটি পুরুষের জন্য। পুরুষের যত্ন-আত্তির দিন। শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে মানসিক স্থিতি ঠিক রাখতে নিজেকে ভালোবাসার দিন। ১৯ নভেম্বর বিশ্বের ৫৭টিরও বেশি দেশে ছোট কিংবা বড় পরিসরে দিনটি উদযাপিত হয়।
নারী দিবসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দিনটি আসেনি। কবি নজরুল আবারও প্রাসঙ্গিক এখানে। তিনি লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ এ সত্য মেনে পুরুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোই দিনটির মূল লক্ষ্য।
কীভাবে এলো পুরুষ দিবস
১৯৬৮ সালের কথা। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সম্পাদকীয় লেখেন আমেরিকান সাংবাদিক জন পি হ্যারিস। ওই লেখায় খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের আড়ালে বৈষম্য চলছে বলে দাবি করে বসলেন তিনি। কারণ হিসেবে হ্যারিস জানান, দেশটিতে নারী দিবস পালন করা হলেও, পুরুষের জন্য ছিল না আলাদা কোনো দিন।
নারীদের জন্য একটি বিশেষ দিন থাকার বিরোধিতা কিন্তু করেননি হ্যারিস। তার যুক্তি ছিল, শুধু নারীদের জন্য আলাদা দিন মানে এটা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি।
ওই লেখা আলোচনার জন্ম দিলেও পুরুষ দিবস পালনে প্রভাব ফেলার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে বদল হলো দৃশ্যপটের। পুরুষদের জন্যও একটি বিশেষ দিন উদযাপনের কথা ভাবলেন মিসৌরি সেন্টার ফর মেনস স্টাডিজের পরিচালক থমাস ওয়েস্টার।
ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছোট পরিসরে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মাল্টার কয়েকটি সংগঠনকে আহ্বান জানালেন ওয়েস্টার। দুই বছর ধরে বেশ সাফল্যও পেয়েছেন তিনি কিন্তু সেটাকে দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোতে আনতে পারেননি। বরং ১৯৯৫ সালে এসে ব্যর্থতার চিত্রটাই বড় হয়ে ওঠে, দিন পালনে পুরুষরাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসলেন না। তাই অভিমান নিয়ে আয়োজন থেকে সরে দাঁড়ান ওয়েস্টার। এরপর অস্ট্রেলিয়ার আয়োজকরাও উৎসাহ হারান। তবে হাল ছাড়েনি মাল্টা। পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে এই দিবস পালন করেছিলেন তারা।
পুনর্জন্ম
চার বছর পরের কথা। ১৯৯৯ সাল। ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোব্যাগোতে আবারও এক বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে পুরুষ দিবসকে পুনর্জীবন দেন জেরোম তেলুকাসিং। জেরোম ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
বাবাদের জন্যও একটি দিন আছে, কিন্তু যারা এখনও বাবা হননি, কিংবা যারা এখনও কিশোর, তরুণ তাদের উদযাপনে নেই কোনো বিশেষ দিন। এমন ভাবনা দারুণভাবে তাড়িত করে জেরোম তেলুকাসিংকে। মাথার মধ্যে ঘুরছিল, কী করা যায়। জেরোমের জন্মদাতা বাবাই ছিলেন সুপুরুষ হিসেবে তার জন্য বড় প্রেরণা।
তাই বিশ্ব পুরুষ দিবস উদযাপনে বাবার জন্মদিন ১৯ নভেম্বরকেই বেছে নিলেন জেরোম। সেদিন স্থানীয় একটি ক্লাবের ফুটবলারদেরও জড়ো করেছিলেন জেরোম। পুরুষ দিবস উদযাপন করে বিশ্বকাপ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার প্রত্যয় জানিয়েছিলেন তারা। অদ্ভুত বিষয় হলো, ২০০২ সালের বিশ্বকাপে মিস করলেও, ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলেছিল ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোব্যাগো।
জেরোমের হাত ধরে আবারও সামনে আসে পুরুষ দিবস। এই দিনে পুরুষতান্ত্রিকতার নেতিবাচক দিকগুলোকে ছাপিয়ে পুরুষ পরিচয়ের ইতিবাচক বিষয়গুলোকে সামনে আনার চেষ্টা হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা এই দিনটির লক্ষ্য নয়। বরং পুরুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বাড়ানো এবং পুরুষ পরিচয়ের গুণগুলোকে তুলে ধরাই দিনটির মূল লক্ষ্য।
জেরোম প্রবর্তিত এই দিনটি এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই উদযাপিত হয়। যদিও ১৯৯৪ সাল থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পুরুষ দিবস পালন করে আসছিল মাল্টা। ২০০৯ সালে এসে তারাও বদল আনে তারিখে। এখন ১৯ নভেম্বরই পুরুষ দিবস।