৯ বছর আগে সাভারের নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে একটি চক্র। উচ্চ সুদের ওপর ধার করে টাকা দেয়ার এক বছর পরও কোনো টাকা পাওয়া যায়নি বলে জানান ওই শ্রমিকরা। এখন সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে আরও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
বাংলাদেশে পোশাক খাতে সবচেয়ে প্রাণঘাতী আগুনে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে কারখানার ভেতর আগুনে দগ্ধ হয়ে ও লাফিয়ে পড়ে নিহত হন ১১৪ জন শ্রমিক। যারা বেঁচে আছেন, তাদের দিন কাটছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে। নতুন করে কর্মজীবন শুরু করতে গিয়েও বাদ সাধছে শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা।
৯ বছর ধরেই ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের আশায় বুক বেঁধে আছেন ক্ষতিগ্রস্ত অনেক শ্রমিক। এত দিন ধরে চালিয়ে আসছেন নানা আন্দোলন-সংগ্রাম।
গত বছরের নভেম্বরে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর তাজরীনের ৩৬ শ্রমিককে কেন্দ্রীয় শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে অনুদান দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানায়। তবে এক বছরেও সে প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।
উল্টো অভিযোগ উঠেছে, অনুদানের চেক পাইয়ে দেয়ার কথা বলে একটি চক্র ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক লাখ টাকা। ৪৮ জন শ্রমিকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে জনপ্রতি ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা।
অনেকে এ টাকা দিয়েছেন সুদে ধার করে, কিন্তু এক বছরেও অনুদান না পাওয়ায় উল্টো সুদের টাকা গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। পরিবার নিয়ে দুই বেলা খাবার তো দূরের কথা, সুদ কারবারিদের চাপে দিশেহারা এখন তারা। প্রতিনিয়তই শিকার হচ্ছেন লাঞ্ছনা-বঞ্চনার।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাজরীন গার্মেন্টের সাবেক শ্রমিক জরিনা বেগম, মো. সোলাইমান ও এমদাদ হোসেন এই টাকা সংগ্রহ করেছেন। তবে কী কারণে টাকা তুলেছেন সে বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি শ্রমিক নেতাদের।
তাজরীন গার্মেন্টের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে নাছিমা বেগম একজন। তিন সন্তান ও তাজরীনের ঘটনায় পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে থাকেন ভাড়া বাসায়। নাছিমারও দুই পা ভেঙে গিয়েছিল। শরীরের অনেক স্থানেই পেয়েছেন মারাত্মক ব্যথা। তারপরও পরিবার বাঁচানোর তাগিদে একটি ঝুট গুদামে কাজ নিয়েছেন তিনি।
তাজরীন গার্মেন্টের সাবেক শ্রমিক জরিনা বেগম ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা তুলেছেন
নাছিমা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর আমরা প্রেস ক্লাবে আছিলাম তিন মাস। পরে ওইখান থাইকা পুলিশ আমাগো খ্যাদাই দিছে। অ্যারপর আমরা জলি আপার পার্টি অফিসে গেছিলাম। ওইখানে জরিনা আমাগো অনেক অত্যাচার করছে। ১৩ দিনে ওই খানে ২০০ ট্যাকার খাবার খাইছি। ওইখান থাইকা সব শ্রমিকরে অত্যাচার কইরা জরিনা বাসায় পাঠায় দিছে। তারপরের দিন জরিনা ফোন দিল যে, সবাই মিলা ট্যাকা রেডি করো এক-দুই দিনের ভিতর।’
তিনি বলেন, ‘তহন আমরা মনে করছি, এত কষ্ট করতেছি তাইলে ধারদেনা যে ভাবেই হোক আমরা করি। দুই-চার দিনকার লাইগা দিলে আমরা দিয়া দিমু। ওই অনুযায়ী দুই দিনকার কথা কইয়া সুদে ট্যাকা নিয়া আমরা দিছি। অনুদানের চেক পাওয়াই দিবে কইয়া এমন সবার কাছে ট্যাকা নিছে।
‘সবার কাছ থেকে ৬ হাজার করে ট্যাকা নিছে। অন্য লোকেরা যাগো দেওয়ার মতো সামর্থ্য, হ্যারা ১০ হাজার কইরাও দিছে। আমি আর আমার স্বামীর ১২ হাজার ট্যাকা দিছি। হাজারে ২০০ কইরা ট্যাকা সুদ কইরা নিছি। হেই ট্যাকার কী যে যন্ত্রণা! প্রায় এক বছর হইয়া গেছেগা ওই ট্যাকা। আমি একটা ঝুটের গোডাউনে কাজ নিছি। খাইতেই পারি না ঠিকমতো, সুদের ট্যাকা আর আসল কই থাইকা দিমু? আর এত দিন হইছে চেকও পাই নাই।’
তাজরীনে আরেক আহত শ্রমিক নাটা বেগম বলেন, ‘৬ মাস চলে সুদের উপরে টাহা আনছি। ৬ হাজার টাহা দিছি আমি। আরো অনেকে দিছে টাহা। সুদের টাহা, আসল টাহা সব চায়। ওরা (সুদ কারবারি) বকাবাজি গালিগালাজ করে, মারবার আহে। না দিলে পুলিশে ধরায় দিব বইলা হুমকি দেয়। পরে বাড়িয়ালা ওগো থামাইছে। অনেক লোক আছে সুদে টাকা নিয়া দিছিল। সবার একি অবস্থা।’
অনুদান পেতে টাকা দিয়েছিলেন নাটা বেগমও
রূপা আক্তার নামের আরেক শ্রমিক অনুদানের টাকা পাওয়ার আশায় জরিনা বেগমকে ধারকর্য করে ৬ হাজার টাকা দিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে তাজরীনের শ্রমিক জরিনা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘না, অসম্ভব। মিথ্যা কথা কইলেই তো হইব না। এটা পুরা মিথ্যা কথা এহোন। কারও নাম বিক্রি কইরা কারো নামের উপরা টাকা নেয়া হয় নাই। সব শ্রমিকের মইদ্দে বইসা আলোচনা হইছে যে, আমরা যদি টাকা পাই তাইলে আমরা এহান থাইকা যামুগা। আমরা কিছু টাকা সবাই আগেই তুইলা দিয়া যাতে নেতারা কষ্ট করতাছে আমরাও খুশি হমু। ওদেরও আমরা খুশি কইরা যামু। কেউ তিন, চার, পাঁচ, ছয় হাজার আবার কেউ দুই হাজারও দিছে।’
মোট কত টাকা তোলা হয়েছে এবং ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে বলেন, ‘অলরেডি অনেকের টাকা রিটার্ন দেয়া হইছে। এটার তালিকা সোলেমান ভাইয়ের কাছে, সঠিক আমার খেয়াল নাই। সোলেমান ভাই লিখছে। আর কিছু টাকা খরচ হইছে। নেতাগোরে পার্টি অফিসে খাওয়ানো হইছিল।’
তবে অনেকবার সোলাইমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
শ্রমিকদের তথ্য অনুযায়ী এই টাকা তোলা হয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও সিপিবির সম্পাদক জলি তালুকদার ও কলকারখানার অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক এ কে এম সালাহ উদ্দীনের নাম ভাঙিয়ে।
জানতে চাইলে জলি তালুকদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা তো আপনি অনেক দিন পরে বললেন। ওইটা আমরা সঙ্গে সঙ্গেই পদক্ষেপ নিছি। আমরা একটু দেরিতে ১০-১২ দিন পরে শুনেছি।’
তিনি বলেন, ‘অুনদানের চেক পাইয়ে দেবে এই আলাপ আমি জানি না। সোলেমান এবং জরিনাকে আমরা চাপ দিয়ে তখন বলছি যে, দ্রুত শ্রমিকদের টাকা ফেরত দেন। সম্ভবত তারা কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিছে। আর কিছু বাকি রইছে। ওইটার একটা হিসাব সোলেমান, জরিনা এবং শ্রমিকদের নিয়ে বসেই আমরা করছিলাম। কত জনকে দিছে আর কত জনকে দেয় নাই। ওইটার একটা ক্লিয়ার হিসাব আবার বসে ক্লিয়ার করার কথা যে, আসলেই ওরা কতজনকে পরিশোধ করতে পারছিল।’
শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার
শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা কেন ওঠানো হয়েছিল- এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আমি তো এটা জানি না। শ্রমিকরা ওইটা একসঙ্গে বসে করছে। আমি টোটালি জানি না।’
নেতা-কর্মীদের দেয়ার জন্য শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা উঠানো হয়েছিল কি না এমন অভিযোগ শুনে জলি তালুকদার কিছুটা রাগত স্বরে বলেন, ‘কাকে খাওয়াইছে? কার খাওয়া এখানে দরকার বলেন তো?’ টাকাটা কি আমি নিছি? আপনি আবার আমাকে এটা কেন জিজ্ঞেস করতেছেন? আপনি কি হ্যারাস করার জন্য ফোন করছেন? আমাকে হ্যারাস করার আগে কি আপনি এটা ভাবছেন- এটা আমাকে বলা উচিত কি উচিত না?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘এটার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত। এগুলা সব সিন্ডিকেট। এরা রানা প্লাজা, তাজরীনের শ্রমিকদের পুরা বারোটা বাজায় ছেড়ে দিচ্ছে।
‘ধরেন, তাদের (ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক) কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে, চিকিৎসা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা নেয়। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা কেউ স্বীকার করে না, কিন্তু তারা যখন টাকা পায় না তখন তারা এসব আমাদের কাছে স্বীকার করে। এই শ্রমিকরা যারা তিনবেলা খাইতে পারে না ঠিক মতো। অথচ তাদের কাছ থেকে এই ভাবে দুর্নীতি করে টাকা নেয়াটা খুব কষ্টদায়ক।’