প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের দৈনিক টিফিন খরচ মাত্র সাড়ে ছয় টাকা। সরকারের দেয়া এ বরাদ্দে বেজায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা। এটাকে তারা তাদের প্রতি অসম্মান বলে মনে করেন। পরিবর্তে দৈনিক মধ্যাহ্নভোজের ভাতা দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন খুদে শিক্ষার্থীদের শিক্ষকরা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জাতীয় বেতন স্কেল-২০০৯ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা টিফিন ভাতা বাবদ মাসিক ১০০ টাকা পেতেন। ২০১৪ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে এই ভাতা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হয়। এরপর সর্বশেষ অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে এই ভাতা ২০০ টাকা করা হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রাথমিকের শিক্ষকরা দৈনিক টিফিন ভাতা পান সাড়ে ছয় টাকার সামান্য বেশি বা ছয় টাকা ৬৬ পয়সা।
শিক্ষকরা জানান, এই সামান্য টাকা দিয়ে নাশতা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিমা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের দৈনিক ২০০ টাকা হারে ‘লাঞ্চ’ বা দুপুরের আহার ভাতা দেয়া হয়।
জানতে চাইলে মগবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামসুন নাহার বেগম বলেন, ‘একজন শিক্ষককে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্কুলে থাকতে হয়। এ সময়ের মধ্যে কয়েকবার তাকে নাশতা করতে হয়। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, তাতে নাশতা বাবদ প্রতিদিন ১০০ টাকা লাগে। তাই অবিলম্বে টিফিন ভাতার পরিবর্তে লাঞ্চ ভাতা দেয়ার দাবি জানাই।’
একই কথা বললেন নয়াটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘সাড়ে ছয় টাকা দিয়ে বড় জোর এক কাপ চা পাওয়া যায়। এর বেশি কিছু না। তাই সরকারের উচিত যারা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর, তাদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে টিফিন ভাতার পরিবর্তে দৈনিক লাঞ্চ ভাতা দেয়া হয়। আমরা চাই এখানেও তা দেয়া হোক।’
টিফিন ভাতাকে ‘অসম্মানজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি রাজেশ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষক টিফিন ভাতাকে অবমাননাকর মনে করায় তা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, বিমাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে লাঞ্চ ভাতার টাকাও দেয়া হয়। এ ছাড়া অনেক অফিস খাবারের জন্য ভর্তুকিও দেয়। সে তুলনায় প্রাথমিকের শিক্ষকরা শুধু বঞ্চিতই নন, রীতিমতো বৈষম্যেরও শিকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার থেকে যে হারে টিফিন ভাতা আমরা পাই, তা খুবই সামান্য। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো দৈনিক লাঞ্চ ভাতা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি।’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা। অথচ আমরা কতভাবেই না তাদের অবহেলা করছি। বিষয়টি সত্যিই অসম্মানজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিকে যদি তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন, আমরা কতভাবেই না শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরের শিক্ষকদের অবহেলা করছি। আর একটি কথা না বললেই না, তা হলো আপনি শিক্ষকদের সাধারণ কর্মচারীদের মতো মূল্যায়ন করলে হবে না। মনে রাখতে হবে, তারাই আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর।’
টিফিন ভাতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, ‘এক দিনের টিফিন হিসেবে সাড়ে ছয় টাকা অবশ্য খুবই কম। বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। তবে এটি বাড়ানোর এখতিয়ার আমাদের নেই। আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করব।’
বাংলাদেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৯৩টি। সব মিলিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ।