পাঁচটি সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ আমলে নিয়ে পরীক্ষা বাতিল করলেও এ ঘটনায় নিজ কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির সিসিটিভি অপারেটর নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় দুজন যুগ্ম পরিচালককে বরখাস্ত করার কথা জানিয়েছে তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অফ কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড পাবলিকেশন্সের মহাব্যবস্থাপক (সহকারী মুখপাত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক) জি এম আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বৃহস্পতিবার এ কথা বলা হয়।
গত ৬ নভেম্বর ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সচিবালযের (বিএসসিএস) আওতায় ৫টি ব্যাংকের ‘অফিসার (ক্যাশ)’ পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে স্বীকার না করলেও ১০ নভেম্বর গোয়েন্দা পুলিশ ব্রিফিং করে কীভাবে কারা প্রশ্ন ফাঁস করেছে, এ বিষয়টি জানায়। পরদিন নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই পরীক্ষাটি নিয়েছিল আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মীকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। পরে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে আসে, এই প্রশ্ন ফাঁসে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল।
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্বীকার করার মতোই নিজ কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও স্বীকার করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
আহ্ছানউল্লার তত্ত্বাবধানে আরও দুটি নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা জানিয়ে এতে বলা হয়, ‘প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং অধিকতর তদন্ত কার্যক্রম চলমান।’
ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘প্রশ্ন ফাঁসসংক্রান্ত জালিয়াতির বিষয়ে সম্প্রতি কতিপয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনেকাংশেই তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং সঠিক নয়। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যাপক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে ব্যাপারেও বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক রয়েছে।’
নাম উল্লেখ না করে একজন ডেপুটি গভর্নরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, তাকেও ‘সম্পূর্ণ অসত্য ও ভিত্তিহীন’ বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘উক্ত সংবাদ প্রকাশের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র থেকে যাচাই করে নেয়ার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বচ্ছতা বিধানে সর্বদাই যত্নশীল বলেই প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকবে।’
ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হলে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা দেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে, যা জাতীয় স্বার্থে কখনও কাম্য নয়।’
ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সম্পৃক্ততা না পেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য ‘সিসিটিভি অপারেটর’ পদে ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবরের লিখিত পরীক্ষায় অনিয়মে ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাবুদ এবং মো. আলমাস আলীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি জানানো হয়। বলা হয়, এ জন্য দুজনকে গত ১৩ জুন বরখাস্ত করা হয় এবং অভিযোগের সার্বিক বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আহ্ছানউল্লার কাজ পাওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা
আহ্ছানউল্লাকে পরীক্ষার কাজ পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারে অনিয়মের অভিযোগ এনে গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন এসেছে, তাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যায়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়। প্রচলিত বিধিবিধান স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিপালন নিশ্চিত করে পরিচালক পর্ষদের নির্বাহী কমিটির অনুমোদ নিয়েই এই কার্যাদেশ দেয়া হয়।
পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন কর্মীকে বরখাস্ত করে আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। এক অফিস আদেশে গত ১১ নভেম্বর তিনজনকে বরখাস্ত করার কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। ফাইল ছবি
এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের কোনো পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার প্রভাব বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই বলেও ব্যাখ্যায় দাবি করা হয়।
নিয়োগে প্রভাবিত করার অভিযোগের ব্যাখ্যা
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্ট-১ নিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। অপরদিকে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সচিবালয় শুধু সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের লোকবল নিয়োগের জন্য নিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে।
দুটি আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট উল্লেখ করে ব্যাখ্যায় বলা হয়, দুটি ইউনিট দুজন ডেপুটি গভর্নরের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও স্ব-স্ব অধিক্ষেত্রে তারা আলাদাভাবে কাজ করেন। তাই এ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একে অপরের কাজে প্রভাবিত করার কোনো এখতিয়ার বা সুযোগ নেই।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি এবং বহিঃকেন্দ্রে বদলির জন্য স্বচ্ছ, সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। জ্যেষ্ঠতা বা আবেদনের ভিত্তিতে একজন কর্মকর্তাকে সাধারণত দুই বছরের জন্য বহিঃকেন্দ্রে বদলি বা বহাল করা হয়। এই বিষয়টি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয় উল্লেখ করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সৃষ্টিলগ্ন থেকে এটি একটি দাপ্তরিক রুটিন ওয়ার্ক। তবে প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কর্তৃপক্ষ কোনো কর্মকর্তার বিশেষ দক্ষতাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে যেকোনো সময় যেকোনো প্রজেক্ট/ বিশেষ কাজে পদায়ন/সংযুক্ত করতে পারে।’
রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা
একটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আসে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে দেয়া ঋণ ফেরত আসছে না। এই বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যায়।
এতে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিত রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার নীতিগত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত ও নিয়ন্ত্রিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন্স ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইনভেস্টমেন্ট কমিটির (আইসি) মাধ্যমে। অপারেশনাল বিষয়সমূহ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট অপারেশনাল ম্যানুয়ালের নির্দেশনার আলোকে। রিজার্ভের বিনিয়োগসংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম দৈনিক ভিত্তিতে অডিটও হয়ে থাকে।
ফলে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কার্যক্রমে কোনো একক বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। একইভাবে রিজার্ভের বিনিয়োগ থেকে কারো পক্ষে ব্যক্তিগত কোনো অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করারও সুযোগ নেই।
নিয়মনীতি ও গাইডলাইন্স এর আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত দক্ষতা এবং সফলতার সঙ্গে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যক্রম করে আসছে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘রিজার্ভ হতে বিনিয়োগকৃত সব অর্থই মুনাফাসহ সঠিক সময়ে আদায় হয়েছে এবং হচ্ছে। বিনিয়োগকৃত আসল বা সুদ যথাসময়ে আদায় বা ফেরত না পাওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে অদ্যাবধি ঘটেনি। তাই এ বিষয়ে পত্রিকায় যে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে তাও বস্তুনিষ্ঠ এবং সঠিক নয়।’