বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘মাদক চোরাকারবারির বাড়ি’ সাইনবোর্ড নিয়ে সমালোচনা

  •    
  • ১৮ নভেম্বর, ২০২১ ১৭:৫৭

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘একজনের অপরাধের শাস্তি পুরো পরিবারকে দেয়া যাবে না। এই অপমান ওই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আর একজনের অপরাধের শাস্তি যদি পুরো পরিবার পায়, তাহলে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে এর দায় নিতে হবে।’

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের হবিগঞ্জ অংশে ‘মাদক কারবারি’ ও ‘চোরাকারবারিদের বাড়ি’ চিহ্নিত করে লাল সাইনবোর্ড বসিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

এমন উদ্যোগে মাদক ও চোরাচালান কমবে বলে মনে করছে বিজিবি। তবে আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এর কোনো আইনি বৈধতা নেই। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।

বিজিবি বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কয়েকটি চক্র। নানা কৌশলে তারা এই অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময় চক্রের সদস্যদের আটক করে মামলা দিলেও কারাগার থেকে বেরিয়ে ফের তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।

দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বলছে, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেও মাদক এবং চোরাচালান বন্ধ করা যায়নি। এ অবস্থায় অপরাধে জড়িতদের চিহ্নিত করতে বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।

বাহিনীটির হিসাবে, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবপুর সীমান্ত পর্যন্ত অন্তত দেড় শ বাড়ির আশপাশে এমন সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, কোনো বাড়ির সামনে ‘এটি মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি’ আবার কোনোটিতে ‘এটি চোরাকারবারির বাড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড রয়েছে। লাল রঙের সাইনবোর্ডের ওপর সাদা অক্ষরগুলো দূর থেকেই পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সম্প্রতি এমন কিছু ছবি ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে।

বিজিবি ৫৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এস এন এম সামীউন্নবী চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল উপজেলা থেকে চুনারুঘাট হয়ে মাধবপুর সীমান্ত পর্যন্ত আমার অধীনে। এই জায়গাগুলোতে অন্তত দেড় শ বাড়িতে এমন সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে বিজিবির মামলা আছে তাদের বাড়িতেই মূলত সাইনবোর্ডগুলো লাগানো হয়েছে। পুলিশের মামলাকে আমরা কাউন্ট (হিসাব) করিনি।’

তিনি বলেন, ‘অনেক চেষ্টার পরেও তাদের অপরাধজগৎ থেকে বের করা যাচ্ছে না। তাই সামাজিকভাবে চাপের মুখে থাকলে অপরাধমূলক কাজ ছেড়ে দিতে পারে, এই চিন্তা থেকেই সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বা তারা এ কারবার থেকে সরে এলে সাইনবোর্ডগুলো খুলে নেয়া হবে।’

সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব সমালোচনায় আমি কান দিই না। আমি আইন শক্ত করেই এই কাজে নেমেছি। সুতরাং সমালোচনায় কিছু আসে যায় না।’

একজনের জন্য পুরো পরিবার কেন চিহ্নিত হবে, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিবারের ওই সদস্য কেন মাদক বা চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত? এর দায় পুরো পরিবারের ওপর পড়ে।’

এ বিষয়ে হবিগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাফিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা মাদক কারবারির বাড়ি, চোরাকারবারির বাড়ি, ডাকাতের বাড়ি এভাবে চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগানোর বৈধতা নেই। অপরাধ কর্মকাণ্ডের স্থানগুলো চিহ্নিত করতে পারে। এভাবে বাড়িঘর চিহ্নিত করা এককথায় আইনের ব্যত্যয়। এটা করতে হলে সংসদে আইন পাস করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘একজনের অপরাধের শাস্তি পুরো পরিবারকে দেয়া যাবে না। এই অপমান ওই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আর একজনের অপরাধের শাস্তি যদি পুরো পরিবার পায়, তাহলে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে এর দায় নিতে হবে।’

তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সীমান্তে চোরাকারবারি ঠেকাতে না পারার ব্যর্থতার দায় কী বিজিবির নেই?’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, ‘বিজিবি যেটা করছে সেটা একেবারেই ঠিক করেনি। একজনের জন্য পুরো পরিবারকে এভাবে চিহ্নিত করা যাবে না। এই পরিবারগুলোতে শিশুরা থাকতে পারে, বিবাহ উপযুক্ত তরুণ-তরুণী থাকতে পারে। তারা হয়তো মাদক ও চোরাকারবারির বিরোধিতা করছে। তাদের এখন ভালো জায়গায় বিয়ে হবে না। এমনকি মানুষ তাদের খারাপ চোখে দেখবে, এড়িয়ে চলবে।’

তিনি বলেন, ‘দেশে আইন আছে। প্রচলিত আইনে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের বিচার হবে। আমি মনে করি, এটা বিচারের আগে আরেকটি বিচার হয়ে গেল।’

সিলেটের মানবাধিকারকর্মী ও নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আদালত থেকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকেই মাদক কারবারি বা চোরকারবারি বলা যাবে না। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে নিবারণমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আইনে রয়েছে, থানায় যেমন অপরাধীদের ছবি টাঙানো থাকে। তবে কোনো অবস্থাতেই একজনের অপরাধের জন্য পুরো পরিবারকে হেনস্তা বা হেয় করা যাবে না। এমনটি করা হলে অপরাধীকে চিহ্নিত করার নামে আসলে আরেকটি অপরাধই করা হয়।’

সিলেটের নাগরিক সংগঠক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘এটা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। মাদক কারবারি হোক, চোরাকারবারি হোক আর ডাকাত হোক, কারও বাড়িকে এভাবে চিহ্নিত করে সমাজের কাছে আজীবনের জন্য দণ্ডিত করা কোনো বিচারেই ন্যায়সংগত নয়। এভাবে একজনের অপরাধের জন্য বাড়ির সবাইকে হেয় করাটাও অপরাধ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা যেমন অপরাধী, তেমনি তাদের বাড়ির সামনে এই ধরনের সাইনবোর্ড বসিয়ে বিজিবিও অপরাধ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীকে ধরবে এবং আইনের মধ্যে থেকে বিচারের মুখোমুখি করবে। কিন্তু এ কারণে অপরাধীর পরিবারের অন্য সদস্যকে হয়রানি বা এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যার ফলে সমাজ তাদের অন্যভাবে দেখে।

তিনি আরও জানান, আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ অপরাধী হয় না।

এ বিষয়ে বিজিবির অপারেশন শাখার পরিচালক লেফেটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় মাদক কারবারিদের চিহ্নিত করে তার বাসায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার কার্যক্রম সামনেও চলবে। তবে কেউ যেন অন্যায়ভাবে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন না হয়, সেজন্য আমরা আরও একটু বেশি সতর্ক থাকছি। মাদকসেবী আর মাদককারবারি এক বিষয় নয়।

‘মাদক কারবারিদের চিহ্নিত করতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে সমন্বিতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই কাজ করছে। অন্যসব বাহিনীর মতো আমরাও মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণ করতে এই কাজ করছি। এটি কোনো আইনের প্রয়োগ নয় বরং আমরা এই প্রক্রিয়ায় সমাজে মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে চাচ্ছি।’

এই কার্যক্রমে পুরো পরিবার বা নিরীহ কেউ সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মাদক কারবার করছে এবং তার পরিবার জানার পরও তাকে সেপথ থেকে ফিরিয়ে না এনে সায় দিয়ে যাচ্ছে সেই পরিবারও তো সমানভাবে অপরাধী। এমন হলে তার পরিবারকে দায় নিতে হবে। আমরা অনুসন্ধান করে যেসব মাদক কারবারিদের পেছনে পরিবারের মদদ আছে, সেসব বাড়িতে সাইনবোর্ড লাগাচ্ছি।

‘মানবাধিকারকর্মীরা বিষয়কে তাদের দৃষ্টিতে একভাবে দেখলেও অপরাধ দমনে আমাদের কিছু স্টেপতো নিতে হবেই, তারমানে এই না যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানবাধিকারের জায়গাটা রক্ষা করে না। এটা পুরোপুরি জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রম। যেখানে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয় জনগণও অংশ নিচ্ছে।’

এ বিভাগের আরো খবর