বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়ার সুযোগ না দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সম্প্রতি বিদেশ সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একজন গণমাধ্যমকর্মীর এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমার কাছে চান কীভাবে বলেন তো? খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি না?’
তিনি বলেন, ‘আপনাকে কেউ যদি হত্যা করার চেষ্টা করত, আপনি তাকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেন? বলেন আমাকে?’
২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ড হওয়া বিএনপি নেত্রীকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বাসায় ফেরার সুযোগ করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিএনপি নেত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনে সাড়া দিয়ে নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিতের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে গুলশানের বাসভবনে পৌঁছেন বিএনপি নেত্রী।
সে সময় দুটি শর্তে এই দণ্ড স্থগিত করা হয়, যার একটি ছিল খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যাবেন না। তবে গত এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের নেত্রীকে দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার দাবি জানানো হয়।
সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী আবার অসুস্থ হয়ে গেছেন এবং তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে আবারও বিদেশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
মাহমুদ আল ফয়সাল নামে একজন গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি বলেছে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় তারা অংশ নেবে না। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এই ইস্যুতে কোনো বক্তব্য নেই। আমরা একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আগামী নির্বাচনে দেখতে চাই। এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আপনার সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো সংলাপের উদ্যোগ নেবেন কি না।
‘আরেকটি বিষয় আপনাকে বলি, মনজুরুল আহসান বুলবুল একটি প্রশ্ন করেছিলেন, তার একটি অংশ হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ট্রিটমেন্টের বিষয়টি এখন ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কি না?’
প্রধানমন্ত্রী প্রথম প্রশ্ন নিয়ে কিছু বলেননি, দ্বিতীয় প্রশ্নটির প্রসঙ্গে তিনি উপরিউক্ত মন্তব্য করার পাশাপাশি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলাসহ নানা প্রসঙ্গ টানেন।
সেই সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘আপনার পরিবারকে কেউ যদি হত্যা করত, আর সেই হত্যাকারীকে যদি কেউ বিচার না করে, পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিত, তাদের জন্য আপনি কী করতেন?
‘আমি থাকতে হত্যাকারীকে ১৫ ফেব্রুয়ারি, ৯৬ সালের ইলেকশনে ভোট দিয়ে পার্লামেন্টে বসাল। যেখানে আমি বিরোধী দলের নেতা বসতাম, সেখানে বসানো হল কর্নেল রশিদকে। কী করেছিল খালেদা জিয়া?’
খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আরেক খুনি খায়রুজ্জামানকে চাকরি দেয়ার কথা তুলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘চাকরি দিল ফরেইন মিনিস্ট্রিতে, অ্যাম্বাসেডর করে পাঠাল। পাশা (আজিজ পাশা) একজন খুনি। মারা গেছে। মৃত ব্যক্তিকে ক্ষমতায় এসে প্রমোশন দিয়ে তার অবসর ভাতা দিয়ে দিল।’
২০০৪ সালে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নানা বক্তব্যের প্রসঙ্গও টানেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার পর বলে দিল কী? আমি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে নিজেই আত্মহত্যা করতে নিজেই নিজেকে মেরেছিলাম।’
২০০১ সালে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা পেতে হত্যাচেষ্টার বিষয়েও খালেদা জিয়ার বক্তব্য স্মরণ করান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘কোটালিপাড়ায় বোমা যখন পোঁতে, তার আগে তার বক্তব্য কী ছিল? শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, কোনো দিন বিরোধী দলের নেতাও হতে পারবে না। সেই কথাও বলেছিল। ভেবেছিল, মরেই তো যাব।’
‘রাখে আল্লাহ মারে কে, আর মারে আল্লাহ রাখে কে?’ বহুল প্রচলিত এই কথাটি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ-প্রধান বলেন, ‘আমার বেলায় সেটা হচ্ছে যে রাখে আল্লাহ মারে কে।’
প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক মাহমুদ আল ফয়সালকে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারপরও খালেদা জিয়ার জন্য এত দয়া দেখাতে বলেন? কেউ এই প্রশ্ন করলে আমার মনে হয় আপনাদের একটু লজ্জা হওয়া উচিত। দরকার নাই তো আমাকে বলার। যারা আমার বাপ, মা, ভাই, ছোট্ট রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করেছে…’
নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করিয়ে বাড়ি ফেরার সুযোগ করে দেয়ার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারপরেও আমরা অমানুষ না। অমানুষ না দেখেই তাকে আমরা অন্তত তার বাসায় থাকার ব্যবস্থাটুকু… এক্সিকিউটিভ অথরিটি আমার হাতে যতটুকু আছে, সেটুকু দিয়ে তাকে বাসায় থাকার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আর বাকিটা আইনগত ব্যাপার।’
গ্রেনেড হামলার পর সে সময় সংসদের ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এতজন আহত আমাদের, ২৪ জন মানুষ মারা গেছে, পার্লামেন্টে একদিন আলোচনা করতে দেয়নি। আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারিনি।
‘এত বড় অমানবিক যে, তাকেও আমি মানবতা দেখিয়েছি। আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার সেটুকু আমি দেখিয়েছি। আর কত চান? আর কত চান আমাকে বলেন?’ সেই সাংবাদিককে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্র্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন সে অসুস্থ। ওই যে আমি বললাম না রাখে আল্লাহ মারে কে, মারে আল্লাহ রাখে কে। সেটি মনে করে বসে থাকেন। আমার কিছু করার নেই। আমার যতটুকু করার আমি করেছি। এটা এখন আইনের ব্যাপার।’
এই প্রশ্ন নেয়ার পর আরও একজন সাংবাদিক উঠে দাঁড়ালে তাকে সুযোগও দেননি সরকারপ্রধান। কিছুটা খেদের সুরে বলেন, ‘আমি আর প্রশ্ন নেব না। মানুষ এত নিষ্ঠুর আর অমানবিক হলে কাদের জন্য খাটি?’