চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আসবাবপত্র, আঙিনায় চলছে রান্না। এলোমেলো কাপড়চোপড়ের স্তূপের পাশে বসে খেলছে শিশুরা।
এ দৃশ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের জহরপুর সর্বজনীন দুর্গামন্দিরে। সেখানে এক সপ্তাহ ধরে আশ্রয় নিয়ে আছে ৯টি পরিবার।
মন্দিরের সামনে মাটির চুলায় রান্না চড়িয়েছেন সনোকা রানী। তিনি জানালেন, তার বাড়ি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জোহরপুর গ্রামে। গত সপ্তাহে এই গ্রামের কয়েকটি বাড়ি দেবে গেছে। সেসব বাড়ির লোকজন উপায় না দেখে এই মন্দিরে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন।
রান্না করতে করতে সনোকা বলছিলেন, তারা হালদার সম্প্রদায়ের। পাঁচ বছর আগে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটা গরু কিনেছিলেন। সেই গরু বিক্রির টাকার সঙ্গে ঋণের টাকা জুড়ে দুটো পাকা আর দুটো টিনের ঘর করেছিলেন।
দুই ছেলে ও পুত্রবধূকে নিয়ে ভালোই কাটছিল তাদের। ঋণের কিস্তিও শোধ করেছিলেন। গত সপ্তাহে পুরো বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সব হারিয়ে তারা এখন মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছেন।
সনোকা রানী বলেন, ‘স্বামী মাছ মারে, ছেলেরা মাছ মারে, রিকশা চালায়, যখন যেটা পায় তখন সেটা করে। এটার ওপরই বাড়িটা বানিয়্যা ছিলাম। এখন পুরাটাই ভ্যাঙ্গা গেছে। মন্দিরে ৮ দিন থ্যাকা আছি। আমার মতো আরও ৮-৯ ঘর আছে।’
সনোকা বলেন, ‘আমার একার জন্য চাইলে তো হবে না, আমি চাই সরকার আমাদের সবার জন্য, যেটা ভালো হয় সেটা করে দিক। আমাদের সবার জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিক সরকার।’
কবে থেকে ফাটল দেখা দিয়েছে জানতে চাইলে সনোকা রানী জানান, খালের পাড়গুলো গত বছরই দেবে যায়। সে সময় তার নিচ দিকের ঘরগুলোয় ফাটল দেখা দেয়। এ বছর পুরো বাড়িই ধসে গেছে।
মন্দিরের পাশে টিনের চালার খুঁটিতে মাথা দিয়ে বসে আছেন সুন্দরী রানী। তার পুরো বাড়ির মাটি দেবে গেছে। সেটি দেখতে আবার লোকজনও ভিড় করছেন।
সুন্দরী জানান, তার ছোট ছেলে ছোটন বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনার পর থেকে আতঙ্কিত। প্রায়ই ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। বেশ কয়েকবার তাকে হাসপাতালেও নিতে হয়েছে।
সনোকা ও সুন্দরী রানীর মতো অনেকেই বাড়িঘর দেবে যাওয়ায় অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে চলে গেছেন। অনেকে আবার ঝুঁকি নিয়ে সেখানেই থেকে গেছেন। তাদের একজন শ্রী রুপচান হালদার।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, মাটি দেবে যাওয়ায় বাড়ির দুটো ঘর তিনি নিজেই ভেঙে ফেলেন। এতে অন্য ঘর রক্ষা করা গেছে বলে তার ধারণা। যদিও তাকে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছে স্থানীয় প্রশাসন।
রুপচান বলেন, ‘সবাই আসছে আর বলছে বাড়ি থ্যাকা চল্যা য্যাতে, হামরা একটা পলিথিন কিন্যা যে ট্যাংগা থাকব সে টাকা নাই। হামার বাড়ি ছাড়া থ্যাকার কোনো জাগা নাই। এমনকি যে দুখান ঘর ভাংতে হয়্যাছে, সেটায়ও ধারদেনা করা কর্যাছি।’
কানসাট সোলায়মান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক ও ওই এলাকার মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা বড় নালাটির পাড়েই হালদার সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের ঘর তুলে বসবাস করছিলেন অনেক দিন থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারগুলো তাদের বাড়িঘরও বাড়িয়েছে।
‘অনেকটা নিচু জায়গা ভরাট করে তারা নতুন করে বাড়িঘরগুলো করেছিল। বাড়িঘরের যে ভার সেটা এখানকার মাটি ধারণ করতে না পারায় এমনটা হয়ে থাকতে পারে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা মঙ্গলবার দেবে যাওয়া ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই এলাকার বাড়িগুলো খাল ঘেঁষে বানানো। সেখানকার মাটির অবস্থা খুবই খারাপ। এ কারণেই দেবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
‘আরেকটা বিষয় দেখলাম, বিক্ষিপ্তভাবে ওই এলাকার পানি খালে নামত। এটাও ধসের একটা কারণ হতে পারে। তবে খালের পানি থাকা বা না থাকার সঙ্গে মাটি দেবে যাওয়ার কোনো বিষয় নেই।’
মোবারকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘অন্তত ২০টি বাড়ি দেবে গেছে, ১০ থেকে ১২টি বাড়িতে ফাটল ধরছে। ওখানকার লোকগুলো একেবারে গরিব। এরা কষ্ট করে বাড়িগুলো করেছিল।
‘তাদের বাড়ি করার সুযোগ আর কখনও হবে কি না তা আমি জানি না। সরকারিভাবে আমি ইউএনও ও এমপিকে আবেদন করেছি। মৌখিকভাবে আবেদন করেছি। তারাও নিজেরা দেখে গেছেন। এখানে দু-পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সমাধান নাই। এখানে সরকারিভাবে বড় হস্তক্ষেপ না করলে এ গরিব পরিবারগুলোর দুর্দশা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’