প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুর পর তাকে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কবরস্থানে, যেখানে শায়িত আছেন লেখকের স্ত্রী। তবে সোমবার মধ্যরাতে বদলে যায় পরিকল্পনা। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে গুণী লেখককে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে সমাহিত করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
এই পরিবর্তনের কারণ জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার। তিনি বলেন, ‘স্যারের মৃত্যুটা আকস্মিক। যদিও উনি অসুস্থ ছিলেন। উনি যে হঠাৎ করে চলে যাবেন, এটা আমরা ভাবিনি। আমরা ঘটনা জানার পরপরই তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখন পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গোরস্থান আছে, সেখানে কবর দিতে হবে।
‘আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের মাঝে এই চেতনাটা এলো যে, হাসান আজিজুল হক তো শুধু বাংলাদেশের না। ভারতীয় উপমহাদেশের না। উনি তো প্রথমত আমাদের সন্তান। এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। উনি দীর্ঘ ৬০ বছর রাজশাহীতে ছিলেন। ৩৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তার কৃতিত্ব গোটা বাংলাদেশকে আলোড়িত করেছে।’
উপাচার্য বলেন, ‘আমরা চিন্তা করেছি এই অমূল্য ধনকে আমাদের কাছেই রাখতে হবে। তারপর আমরা তার পরিবারের মতামত নিই। আমাদের সিদ্ধান্ত যেটা হবে সেটিই নিতে বলেন তারা। আমাদের মাথায় যেটি এলো, স্যারকে রাখব কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় তো বিশাল প্রাঙ্গণ। কিন্তু শ্রদ্ধার জায়গাতে তাকে রাখতে হবে। কারণ এর আগে আমরা অনেককে এ রকম করে মর্যাদা দিতে পারিনি।
‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, স্যার যেহেতু বিদ্যানুরাগী ছিলেন, বিদ্যা মহারণ্য ছিলেন। লেখাপড়ার মানুষ ছিলেন। তাই লাইব্রেরির যে পবিত্র প্রাঙ্গণ, সেটি স্যারের জন্য যথাযথ হবে। এরপর রাত ১টার সময় সেখানে গিয়ে স্যারের জন্য জায়গাটা দেখি ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করি।’
তিনি বলেন, ‘যিনি চিরকাল জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। অজস্র বই পড়েছেন। অজস্র বই লিখেছেন। উনি বইয়ের সঙ্গে ল্যাইব্রেরির সঙ্গে যদি থাকেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেখানে গেলে হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে জানতে পারবে। তারা নিজেদের উদ্দীপ্ত করতে পারবে।’
উপাচার্য আরও বলেন, ‘উনি অন্য যেসব সম্পদ রেখে গেছেন সেগুলো আমরা সংরক্ষণ করব। লাইব্রেরিতে দরকার হলে একটি বিশেষ কর্নার থাকবে। সেই বইগুলো আমার চেষ্টা করব ডিজিটালাইজড করার। এখানে তার পরিবারের সম্মতি লাগবে। আমাদের বেশ কিছু চিন্তাভাবনা আছে।
‘আমরা যা কিছুই করি না কেন, তার পরিবারের সম্মতি নিতে হবে। তার ছেলে আছে, তিনটি মেয়ে আছে। তাদের সঙ্গে চিন্তাভাবনা আলোচনা করেই হাসান স্যারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করব। উনি যেন আজীবন আলো ছড়ান, সেটি করার জন্য যা যা প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সেই উদ্যোগ নেব।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সোমবার রাত সোয়া ৯টার দিকে নিজ বাড়িতে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন।
গত ২১ আগস্ট হাসান আজিজুল হককে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে প্রথমে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সেই দিন রাতে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়।
চিকিৎসা শেষে গত ৯ সেপ্টেম্বর তিনি ফেরেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে নগরের চৌদ্দপায় এলাকার আবাসিক এলাকা ‘বিহাস’-এর নিজ বাড়ি ‘উজানে’।
হাসান আজিজুল হকের ছেলে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ইমতিয়াজ হাসান জানান, বাবা অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। মাঝে তাকে ঢাকায় নেয়া হয়েছিল। কিছুটা সুস্থ বোধ করায় তাকে আবারও রাজশাহীর বাসায় আনা হয়। কয়েক দিন ধরে বাবার শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছিল না। সোমবার সন্ধ্যা থেকে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। রাত সোয়া ৯টার দিকে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজশাহীতে কাটিয়েছেন।
১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন।
হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে আগুনপাখি, একাত্তর করতলে ছিন্ন মাথা, নামহীন গোত্রহীন, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, শামুক, দেশভাগের গল্প, সাবিত্রী উপাখ্যান।
গুণী এই লেখক একুশ পদক পান ১৯৯৯ সালে। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি ও স্বাধীনতা পুরস্কার। তাকে ডি-লিট পুরস্কার দেয় আসাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।