প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে বড় ধরনের সংস্কার আনছে সরকার। নতুন এই শিক্ষাক্রমের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, পাবলিক পরীক্ষা কমছে। এর পরিবর্তে শিক্ষাবর্ষ জুড়ে চলবে শিখনফলের মাধ্যমে মূল্যায়ন। এতে করে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমার আশা করছে সরকার।
ধাপে ধাপে নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২৩ সালে। আর ২০২৫ সাল থেকে পুরোপুরিভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়বে শিক্ষার্থীরা।
সরকারের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আসবে।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে পাবলিক পরীক্ষা কমবে বলে গণমাধ্যমে একাধিকবার বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমবে। এর বদলে বছরজুড়ে স্কুল-কলেজে বিভিন্ন কার্যক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা তৈরি করেছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। এর পরিবর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এ ছাড়া এসএসসির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হবে না। পরীক্ষার চাপ কমাতে শিক্ষাবর্ষজুড়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন চলবে।
যেভাবে মূল্যায়ন
প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির আগে স্কুলে কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। পুরোটাই হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান- এই বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ, আর সামষ্টিক মূল্যায়ন (বার্ষিক পরীক্ষা) হবে ৪০ শতাংশ।
একইভাবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ। বাকি বিষয়গুলোতে সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ।
এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির মতো বাকি বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ শতাংশ।
নবম ও দশম শ্রেণিতে গিয়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ দশম শ্রেণির মোট ১০টি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটির পরীক্ষা হবে এসএসসিতে। বাকি বিষয়গুলোতে ১০০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন।
বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হয়। এখন গড়ে ৩২ কর্মদিবস লাগে এসএসসি পরীক্ষা নিতে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে পাঁচ কর্মদিবসেই পরীক্ষা গ্রহণ শেষ হবে।
শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী, একাদশ ও দ্বাদশে আবশ্যিক বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। প্রায়োগিক বা ঐচ্ছিক বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন ১০০ শতাংশ। এই দুই শ্রেণিতে সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্প ও ব্যবহারিক ভিত্তিতেও শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।
উচ্চ মাধ্যমিকে (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) ছয়টি বিষয়ে ১২টি পত্র থাকবে। একাদশ শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে বাংলা, ইংরেজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থী যে শাখায় পড়বে, সেই শাখার প্রতিটি বিষয়ের প্রথম পত্রের (মোট তিনটি) পরীক্ষা হবে। অর্থাৎ একাদশ শ্রেণিতে মোট ছয়টি বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা হবে।
আর দ্বাদশ শ্রেণিতে নিজ নিজ শাখার তিনটি বিষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রের মোট ছয়টি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সম্মিলিত ফলের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিকের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হবে।
শিক্ষাবিদরা যা বলছেন
নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা কমিয়ে আনার বিষয়কে ইতিবাচক বলছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, এর ফলে লেখাপড়া আনন্দদায়ক হবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় পাবলিক পরীক্ষা কমিয়ে আনার প্রস্তাব অবশ্যই ইতিবাচক। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ কমবে এবং তারা মুখস্থ-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসবে।
একই কথা বললেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না হওয়াটা অত্যন্ত যৌক্তিক। এর ফলে ছোট শিশুরা অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে রেহাই পাবে। সে সুবাদে শিশুদের কাছে লেখাপড়াটা আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে।