তখন ২০০৬ সাল। দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঙ্গিবাদ। নানাভাবে বিকৃত করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
এমন অস্থির সময়ে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য সিলেটে গড়ে ওঠে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি তরুণদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তোলারও উদ্যোগ নেয় সংগঠনটি। এই দুই লক্ষ্যে আয়োজন করা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের বইপড়া উৎসব’।
‘জ্ঞানের আলোয় অবাক সূর্যোদয়!/এসো পাঠ করি/ বিকৃতির তমসা থেকে/ আবিষ্কার করি স্বাধীনতার ইতিহাস’- এ স্লোগানে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটির নাম রাখা হয় ‘ইনোভেটর’।
টানা ১৫ বছর ধরে তরুণ ও কিশোরদের বই পড়ানো ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। এমনকি করোনা সংক্রমণের কারণে সব কিছুতেই যখন স্থবিরতা, তখনও থেমে থাকেনি ইনোভেটরের কার্যক্রম। ঘরবন্দি সেই সময়ে তারা আয়োজন করে ‘অনলাইনে বইপড়া কর্মসূচির’। প্রতি মাসে একটি করে নতুন বই পড়ানো হয় এতে অংশগ্রহণকারীদের।
শুরুতে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিল বই পড়া ও ইতিহাস জানানোর এই উদ্যোগ। তবে দিনে দিনে তার ব্যাপকতা বেড়েছে। এখন প্রতিবছর এই কর্মসূচিতে হাজারখানেক শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এতে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। এরপর উৎসব করে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে নির্বাচিত বই তুলে দেয়া হয়। সকলের বই পড়া নিশ্চিত করতে বিতরণকৃত বইয়ের ওপর একটি নির্ধারিত সময়ের পর পরীক্ষা নেয়া হয়। এতে বিজয়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয় আয়োজন করে।
এখন সিলেটের অন্যতম বড় কর্মসূচিতে পরিণত হওয়া এই উদ্যোগের শুরুর দিকটা এতটা মসৃণ ছিল না।
এ প্রসঙ্গে ইনোভেটরের নির্বাহী সঞ্চালক প্রণবকান্তি দেব বলেন, ‘যে সময়ে আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছিলাম, তখন তরুণদের সঠিক ইতিহাস জানার পথ রুদ্ধ ছিল। ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছিল। জঙ্গিবাদ আর মৌলবাদ বিস্তার লাভ করায় তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছিল।’
তিনি বলেন, ‘এ রকম সময় আমাদের এই উদ্যোগকে অনেকে ভালোভাবে নেননি। মুক্তিযুদ্ধের বই পড়ানো কেন- এমনও প্রশ্ন তোলা হতো। পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসত কেউ। এ ছাড়া আমরা যে বইগুলো পড়ানোর জন্য নির্ধারণ করতাম, চাহিদামতো তার কপি পাওয়াও যেত না।’
এখন এসব সংকট পেরিয়ে এসেছে ইনোভেটর। তাদের বইপড়া আয়োজনে এখন পৃষ্ঠপোষকতা করে সিলেট জেলা পরিষদ।
তবে এখন নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
প্রণবকান্তি দেব বলেন, ‘করোনার কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও খোলেনি। এ ছাড়া পরিবারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই পড়ার তেমন চর্চা নেই। আর তরুণরা এখন মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। বই পড়ায় তাদের আগ্রহ কমেছে। তাদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে অনেক বেগ পেতে হয়।’
তবে এমন চ্যালেঞ্জ জয় করেই এগিয়ে চলছে বই পড়ার এই উদ্যোগ। প্রথম দিকে কেবল কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এই উদ্যোগ। এখন স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তা বিস্তৃত হয়েছে। তারাও অংশ নেয় বইপড়া কর্মসূচিতে। প্রতিবছর হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। এ পর্যন্ত মোট ১৪ হাজার ৪৭৬ শিক্ষার্থী সরাসরি বইপড়া উৎসবে অংশ নিয়েছে।
২০০৬ সালে প্রথমবার পড়ানো হয়েছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্মৃতিকথাএকাত্তরের দিনগুলি। এরপর একে একে সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন, মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়ার জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা, মাহমুদুল হকের খেলাঘর, শওকত ওসমানের দুই সৈনিক, আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত, শাহীন আখতারের তালাশ, সেলিনা হোসেনের গল্পটা শেষ হয় না, সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান, রাবেয়া খাতুনের মেঘের পরে মেঘ, রশিদ হায়দারের শোভনের স্বাধীনতা, আমজাদ হোসেনের উত্তরকাল, আনিসুল হকের একাত্তরের একদল দুষ্টু ছেলে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ানো হয়।
করোনার কারণে গত বছর অনলাইনে বইপড়া কার্যক্রম চালানো হয়। এবার করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় আবার ‘বইপড়া উৎসব’ আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
উদ্যোক্তারা জানান, নিবন্ধন কার্যক্রম শেষে আগামী ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করা হবে। এ বছর এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছেন। এক হাজার শিক্ষার্থীর নিবন্ধন করানোর লক্ষ্যে কাজ করছেন ইনোভেটরের সদস্যরা।
ইনোভেটরের মুখ্য সঞ্চালক রেজোয়ান আহমদ বলেন, বইপড়া উৎসবের পাশাপাশি আমরা বই বিনিময় উৎসব, পাঠচক্র, বই আলোচনা প্রতিযোগিতা, বই কুইজ, বই বিতর্ক ইত্যাদি আয়োজনের মধ্য দিয়ে তরুণদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। এসব কার্যক্রমে সিলেটের বাইরের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরাও অংশ নিচ্ছে।