পুঁজিবাজারে আবার এক দিনে দুই শতাধিক শেয়ারের দরপতন হলো। বিপরীতে বেড়েছে অর্ধেক সংখ্যক শেয়ারের দর। তবু সূচক বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে লেনদেন।
১১৫টি শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে ২২৭টির পতনের দিন সূচক বেড়েছে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর দর বৃদ্ধির কারণে।
এই পরিসংখ্যানেই এটা স্পষ্ট যে, সোমবারের লেনদেন বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীদেরকে আরও একটু হতাশ করেছে, যদিও খাত হিসেবে ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা ছিল ফুরফুরে মেজাজে।
সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের শেয়ার জাপানি বিনিয়োগ কোম্পানি কেনার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারদর বেড়েই চলেছে। ব্র্যাকের মতো না বাড়লেও একই খাতের বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারদরও বাড়ল।
পাশাপাশি স্কয়ার গ্রুপের দুই কোম্পানি, সঙ্গে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, আইসিবির দর বৃদ্ধিতে সূচকে পয়েন্ট যোগ হয়ে শেষ হলো সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবসের লেনদেন।
আগের সপ্তাহে টানা তিন কর্মদিবস সূচক বাড়ার পর রোববার প্রথম দিন ৬৫ পয়েন্ট সূচক পতনের পরদিন সোমবার আরও ১০ পয়েন্ট পড়ে যায় লেনদেন শুরু হতে না হতেই। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বড় হয়ে উঠার মধ্যেই ব্র্যাকসহ বেশ কিছু কোম্পানির দর বৃদ্ধিতে বেলা ১২টা ৩৭ পয়েন্টে সূচকে যোগ হয় ৬২ পয়েন্ট।
তবে এরপর সেখান থেকে ৫১ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত ১১ পয়েন্ট বেড়ে শেষ হয়েছে লেনদেন।
দিন শেষ সূচকের অবস্থান দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৪১ পয়েন্টে। লেনদেন হয় ১ হাজার ৪২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আগের দিনের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি।
গত বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত এক ঝাঁক কোম্পানি তাদের সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেগুলোর আয় ভালো হয়নি বা যেগুলো লোকসানে আছে, সেগুলোর দরপতন হচ্ছে। তবে দারুণ আয় করার পরেও বিশেষ করে বেক্সিমকো লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মার দরপতন কিছুটা বিস্ময় জাগাচ্ছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের সবশেষ চিত্র
এটাও ঠিক যে, বেক্সিমকো লিমেটেড গত কয়েক মাস ধরে টানা বাড়ছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া বাজার সংশোধনেও এই একটি কোম্পানিই তার দরের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ধরে রাখতে পেরেছে।
তবে সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ গুণেরও বেশি আয় করার তথ্য দেয়ার পর রোববার কোম্পানিটি ৫ টাকার মতো এবং দ্বিতীয় দিন আরও তিন টাকার মতো দর হারিয়েছে।
এর ভিড়ে ব্যাংক খাতের উজ্জ্বল হয়ে উঠা সব খাতের মধ্যেই ব্যতিক্রম বলা চলে। এই খাতের ৩২টি কোম্পানির মধ্যে একমাত্র কোম্পানি হিসেবে ইস্টার্ন ব্যাংকের দর ৩০ পয়সা কমেছে। তিনটি ব্যাংকের শেয়ারদর পাল্টায়নি, বেড়েছে বাকি ২৮টিরই দর। গত কয়েক মাসে এই ঘটনাটি পুঁজিবাজারে দেখা যায়নি।
এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের দর বেড়েছে ৯.৯২ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বেড়েছে ৫.২৬ শতাংশ। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের দর ৪.২৯ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের দর ৩.৩৯ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের দর ২.০৮ শতাংশ করে, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের দর বেড়েছে ২ শতাংশ।
পাশাপাশি শেয়ার প্রতি ৬ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণার পরও দর পড়ে যাওয়া স্কয়ার ফার্মায় বিনিয়াগকারীরা আকৃষ্ট হয়েছেন রোববার প্রান্তিক ঘোষণার পর। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিটি ২৭ শতাংশেরও বেশি আয় করতে পেরেছে।
আর এই গ্রুপের স্কয়ার টেক্সটাইলের আয় বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এই খবরে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে কোনো একক খাতের প্রধান্য দেখা যায়নি। নতুন তালিকাভু্ক্ত দুটি কোম্পানি ছাড়া একটি ছিল ব্যাংক খাতের, দুটি বস্ত্রের, দুটি ছিল ওষুধ ও রসায়ন খাতের একটি প্রকৌশল খাতের আর একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের।
স্কয়ার টেক্সটাইল ও নতুন তালিকাভুক্ত একমি পেস্ট্রিসাইডসের দর বেড়েছে ১০ শতাংশ করে। ব্র্যাক ব্যাংক ছাড়াও নতুন তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর টানা ৮ কর্মদিবস বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
এছাড়া সালভো ক্যামিকেলের দর ৯.২২ শতাংশ, অগ্নি সিস্টেমসের দর ৮.৫ শতাংশ আলহাজ্ব টেক্সটাইলের দর ৭.৬৪ শতাংশ, বেঙ্গল উইন্ডসরের দর ৭.৫১ শতাংশ, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর ৬.৯৭ শতাংশ এবং ওরিয়ন ইনফিউশনের দর বেড়েছে ৪.৩৭ শতাংশ।
সব মিলিয়ে এদিন ১০ শতাংশ দর বেড়েছে দুটির, ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে ৩টি, ৮ শতাংশের বেশি একটির, সাত শতাংশের বেশি দুটির, ৬ শতাংশের বেশি একটির, ৫ শতাংশের বেশি ৩টির, ৪ শতাংশের বেশি ৪টির, ৩ শতাংশের বেশি ৬টির, ২ শতাংশের বেশি দর বেড়েছে ১৬টি কোম্পানির।
এর বেশির ভাগ কোম্পানিই বড় মূলধনি। শেয়ার সংখ্যা বেশি হওয়ায় সূচকে এসব কোম্পানির প্রভাব থাকে বেশি।
দরপতনের শীর্ষ ১০
দর বৃদ্ধির হারের তুলনায় দর হারানো কোম্পানির পতনের হার ছিল বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে শেয়ার প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ৩ পয়সা আয় দেখানো ন্যাশনাল ফিডমিল।
এই কোম্পানিটি গত ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদেরকে ব্যাপকভাবে হতাশ করেছে। তৃতীয় প্রান্তিক শেষে শেয়ার প্রতি ১ টাকা ২৫ পয়সা আয় দেখানো কোম্পানিটি চূড়ান্ত আয় দেখিয়েছে শেয়ারে ১৮ পয়সা।
এই কোম্পানিটি দরপতন হয়েছে দিনের সর্বোচ্চ ৯.৯১ শতাংশ।
দরপতনের দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি এক টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করা সায়হাম কটন। এই কোম্পানিটির শেয়ার এক দিনেই দর হারিয়েছে ৯.৫২ শতাংশ।
এ ছাড়া বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম ৯.৪০ শতাংশ, শেয়ার প্রতি ৫ পয়সা আয় থাকার পরও লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া ফুওয়াং ফুড ৯.৩৭ শতাংশ দর হারিয়েছে।
অন্যদিকে ৮.৬০ শতাংশ দর হারিয়েছে দুই বছর মিলিয়ে শেয়ার প্রতি ৩৫ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করা আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে বড় লোকসান থেকে বের হয়ে এবার মুনাফায় ফেরার ভালো খবরে ৮.৫৯ শতাংশ দর পড়ে গেছে জেমিনি সি ফুডের।
প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি দুই টাকার বেশি লোকসান দেয়া স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস ৮.৫০ শতাংশ, ড্রাগন স্যোয়েটার ৮.১৫ শতাংশ, লোকসানি মেঘনা মিল্ক ৭.৩১ শতাংশ এবং বিবিএস ক্যাবলস দর হারিয়েছে ৬.২২ শতাংশ।
সব মিলিয়ে ৪টি কোম্পানি ৯ শতাংশের বেশি, ৪টি কোম্পানি ৮ শতাংশের বেশি, একটি কোম্পানি ৭ শতাংশের বেশি, ৪টি কোম্পানি ৬ শতাংশের বেশি, ৭টি কোম্পানি ৫ শতাংশের বেশি, ১২টি কোম্পানি ৪ শতাংশের বেশি, ২৬টি কোম্পানি ৩ শতাংশের বেশি, ৩৯টি কোম্পানি ৪ শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে।
এগুলোর মধ্যে বড় মূলধনি কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। ফলে এই দরপতন সূচকে প্রভাব ফেলেছে কমই।
সূচক নিচের দিকে সবচেয়ে বেশি টেনে ধরেছে ১.৮৩ শতাংশ দর হারানো বেক্সিমকো লিমেটেড। এ ছাড়া বেক্সিমকো ফার্মা, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট দুই শতাংশের বেশি দর হারিয়ে সূচক টেনে ধরায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে।
আগ্রহের ১০ কোম্পানি
দরপতন হলেও লেনদেনের শীর্ষে যথারীতি বেক্সিমকো লিমিটেড। এই একটি কোম্পানিরই ১৯৪ কোটি ২৫ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা দর হারাতে থাকার পর বিকাশের শেয়ার বিক্রির ইস্যুতে উত্থান ঘটা ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারে লেনদেন হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৭ কোটি ১১ লাখ টাকা।
আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারে লেনদেন হয়েছে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
শীর্ষ দশের অন্য কোম্পানিগুলো হলো ওরিয়ন ফার্মা, জেনেক্সিল ইনফোসিস, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মা, এনআরবিসি, কাট্টালি টেক্সটাইল ও আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ।
প্রধান খাতগুলোর মধ্যে ব্যাংক ছাড়া দিনটি ভালো গেছে বলা চলে তথ্য প্রযুক্তি খাতে। এই খাতের ১১টি কোম্পানির মধ্যে ৭টিরই দর বেড়েছে। কমেছে বাকি ৪টির।
অন্যগুলোতে দিনটি ভালো যায়নি বলাই চলে। সিমেন্ট খাতের ৭টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩টির, কমেছে চারটির
প্রকৌশল খাতের ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে কেবল ৮টির, একটির দর ছিল অপরিবর্তিত আর কমেছে বাকি ৩৩টির দর।
ব্যাংকবহির্ভুত আর্থিক খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে একটির লেনদেন স্থগিত। বাকিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ৯টির, কমেছে ১১টির, আর দর ধরে রাখতে পেরেছে ২টি কোম্পানি।
খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ২০টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৬টির, একটি দর ধরে রাখতে পেরেছে, হারিয়েছে বাকি ১৩টি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে বেড়েছে ৭টির দর, একটির দর ছিল অপরিবর্তিত, কমেছে বাকি ১৫টির দর।
বিমা খাতে ৫২টি কোম্পানির মধ্যে বেড়েছে ১৪টির দর, একটির দর ছিল অপরিবর্তিত, কমেছে বাকি ৩৭টির দর।
বিবিধ খাতের ১৪টি কোম্পানির মধ্যে দর হারিয়েছে ১১টিই। বেড়েছে বাকি ৩টির দর।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে দর বেড়েছে ১১টির, দর হারিয়েছে ৮টি, অপরিবর্তিত ছিল বাকি ১৭টির দর। যেগুলোর দর বেড়েছে বা কমেছে, সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগের দর পাল্টেছে ১০ পয়সা করে।
ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৩২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৯টির। একটির লেনদেন দীর্ঘদিন ধরেই স্থগিত। লভ্যাংশ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেটের কারণে লেনদেন হয়নি আরও একটির। কমেছে বাকি ২১টির দর।
আর বস্ত্র খাতের ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে কেবল নয়টির, লভ্যাংশ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেটের কারণে স্থগিত ছিল তিনটির দর, ৬টির দর পাল্টায়নি। কমেছে বাকি ৪০টির দর।