উপকূলে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডর যখন আঘাত হানে তখন বরগুনার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রে ভূমিষ্ঠ হয় এক কন্যাশিশু, যার নাম রাখা হয় মারিয়া। সিডরের সময় জন্মানোয় দেশে তো বটেই, সারা বিশ্বে সে পরিচিতি পায় ‘সিডর বেবি’ হিসেবে।
মারিয়া ও তার পরিবারকে নতুন ঘর দেয়ার পাশাপাশি ভরন-পোষণের আশ্বাস দেয় একাধিক উন্নয়ন সংস্থা। কথা রাখেনি কেউই। অভাব-অনটনের মধ্যেই বেড়ে উঠছে ‘সিডর বেবি’।
মারিয়ার বয়স এখন ১৪। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বলেশ্বর পাড়ের পদ্মা গ্রামের মা-বাবার সঙ্গে থাকে। বাবা ফারুক মোল্লা ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে সংসারের খরচ মেটান।
১৪ বছর আগে সিডরের সময় তোলা ছবি মারিয়ার হাতে। ছবি: নিউজবাংলা
থাকার জন্য তেমন কোনো ঘর নাই মারিয়াদের। মা জাকিয়া বেগমের পৈতৃকসূত্রে পাওয়া এক খণ্ড জমিতে ঘর তুলে কোনো রকম বসবাস করেন তারা।
অভাবের সংসারে পড়াশোনার সুযোগ হয়নি মারিয়ার। ১৩ বছরেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। বরগুনা পৌরশহরের নয়ন মিয়ার সঙ্গে ২০২০ সালে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর নয়নও আশ্রয় নেয় শ্বশুর বাড়িতে। সেখানে থেকে সাগর নদীতে ইলিশ ধরেন তার স্বামী।মারিয়ার মা জাকিয়া বেগম বলেন, ‘সিডরের সময় আমার এই বাচ্চাডা যহন জন্ম নেয় তহন ব্র্যাক এনজিও আমাগো একটা ঘর দিছিল। বাপের দেয়া জমিতে ঘরটা তুইল্লা সেই ঘরেই মোরা এহনো থাহি। হেরা কইছিল মোর মাইয়ারে পড়ালেহা হরাইবে, গরু দেবে আরও কত্তকিছু কইছিল তহন, কিন্তু ওই ঘরডা ছাড়া কিছু দেয় নাই। মোর মাইয়ার ভরণ-পোষণ তো দূরে থাউক, পড়ালেহার খরচাডাও দেয় নাই। গরিব মানু মোরা। মাইয়া বড় অইছে, বিয়া দিয়া দিছি। ১৪ বচ্ছর আগে দেয়া ঘরডাও ভাইঙ্গা গ্যাছে। হেরা কেউ মোগো আর খবরই লয় নাই।’মারিয়ার নানা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘সিডরের সময় মোর নাতিরে কত্তকিছু দেবে কইয়া গ্যালো হেরা। কিছছু দেয় নাই। মুই মোর নাতিডা থাহার লাইগ্যা এট্টু জাগা দিছি। একখান ঘর দিছিল ব্র্যাক, হেই জাগায় ওই ঘরডায় এহন নাতিডা জামাই লইয়্যা বড় কষ্টে দিন কাডায়।’
১৪ বছর বয়সী কিশোরী বধূ মারিয়া। ছবি: নিউজবাংলা
‘সিডর বেবি মারিয়া’ বলে, ‘সিডরের সময় জন্ম লইয়া মোর জীবনডাও সিডরের মতো অইয়্যা গেসে। নানুর বাড়িত থাহি, আব্বায় যা রোজগার করে হ্যাতে মোগো সংসার চালাইতে একছের কষ্ট। অভাব দেইখা পড়ালেহাও বন্ধ কইর্যা মোরে বিয়া দিয়া দেছে। মোর স্বামী জাইল্লা, যা কামাই রোজগার হরে হেইয়া দিয়া মা বাপের লগে একলগে থাইক্কা খাই।
মারিয়া বলে, ‘মোর লেহাপড়াডা যদি কেউ চালাইয়্যা নেতে তয় মুই অনেক বড় অইতে পারতাম। এই বয়সে মোর স্বামীর সংসার করণ লাগত না।’মারিয়ার জন্মের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল পদ্মা গ্রামের বেশ কিছু বাসিন্দা।
ওই এলাকার ইউপি সদস্য সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সিডরের পরপরই মারিয়াকে দেখতে আসে অনেক দেশি-বিদেশি এনজিওর প্রতিনিধিরা। তারা তখন মারিয়ার ভরণ-পোষণসহ সব দায়িত্ব নেয়ার কথা দিয়ে ছিল। কিন্তু কেউই পরে আর কোনো খোঁজ রাখেনি।’
মায়ের সঙ্গে মারিয়া
বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, দুর্যোগ মুহূর্তে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যারা, সেই এনজিও কর্মকর্তাদের কাছেও খোঁজ নেই সিডর বেবি মারিয়ার। সে সময় মারিয়াকে নানা সহায়তার কথা দিয়েছিল যেসব এনজিও তাদের মধ্যে অন্যতম ব্র্যাক।
ব্র্যাক বরগুনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সমন্বয়ক মারুফ পারভেজ বলেন, ‘মারিয়াকে সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তারপরও আমরা মারিয়ার বিষয়ে খোঁজ নেব। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সহায়তা দেয়া হবে। আমাদের বিভিন্ন কম্পোনেন্ট আছে। আমরা তাকে যেকোনো কম্পোনেন্টের আওতায় আনার চেষ্টা করব।’বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সিডর বেবি মারিয়ার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে আমরা তাকে সরকারের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করব। সুপার সাইক্লোন সিডরের নির্দয় ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে উপকূলবাসী। সে সময় অনেকেই সহায়তার হাত বাড়ালে পরে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের।’
১৪ বছর পর অনেকটা ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা। কিন্তু যে দুর্যোগে মারিয়ার জন্ম, এখনও দুর্ভোগ কাটেনি তার, বরং বেড়েই চলছে।